বন্দুকপ্রেমীরা যথারীতি নীরব

রোনাল্ড রেগনও ‘বন্দুক লবি’র লোক ছিলেন। কিন্তু, তাঁর ওপর যে বন্দুক-আক্রমণ হয়েছিল, সে গুলি তাঁর সেক্রেটারি জেমস ব্র্যাডিকে পঙ্গু করে দিয়েছিল চিরকালের মতো।

Advertisement

পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৭ ০৬:০০
Share:

আমার ধারণা, লাস ভেগাসের এই হাড়হিমকরা গণহত্যার পরেও তেমন কোনও আইনি ব্যবস্থা নিতে, এবং মারণাস্ত্র ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে আমেরিকার ঘষা পয়সার এপিঠ-ওপিঠ দুই দল ব্যর্থ হবে। ন্যাশনাল রাইফল অ্যাসোসিয়েশন ও তাদের জঙ্গিবাদী কর্তারা কানেক্টিকাটে স্কুলের বাচ্চাদের খুন করার পরেও নীরবতা পালন করছিল। লাস ভেগাসের গণহত্যার পরেও তারা নিশ্চুপ। হয়তো তাদের লোকেরা ও রাজনৈতিক নেতারা একটা কিম্ভুত কারণ খুঁজে বের করবে। হয়তো, সেই ইসলামিক স্টেট-এর তত্ত্ব আবার খাড়া করা হবে। হয়তো ঘাতক স্টিফেন প্যাডকের অজানা, না-জানা কোনও গুপ্ত মানসিক রোগ আবিষ্কার করা হবে। অামেরিকা বড় আশ্চর্য দেশ। এখানে কৃষ্ণাঙ্গ বা মুসলিম বা মেক্সিকান অভিবাসী কেউ খুনের দায়ে ধরা পড়লে তাকে তৎক্ষণাৎ সন্ত্রাসী বা গণহত্যাকারী বলে মিডিয়া-চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু কোনও শ্বেতাঙ্গ একই অপরাধ করলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তার মানসিক অবসাদ বা পারিবারিক কোনও দুর্ঘটনা ইত্যাদিকে সামনে নিয়ে আসা হয় খুনের কারণ হিসেবে। আমেরিকার অসংখ্য বেসরকারি জেলে যে দশ লক্ষ মানুষ পচছে, তার হয়তো দশ শতাংশ সাদা, আর বাকি সব কালো বা বাদামি চামড়ার। তার মানে এই নয়, কালো বা বাদামিরা বেশি অপরাধপ্রবণ। এই বন্দিদের বেশির ভাগই এত গরিব যে ভাল আইনজীবীর কাছে যাওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই।

Advertisement

রোনাল্ড রেগনও ‘বন্দুক লবি’র লোক ছিলেন। কিন্তু, তাঁর ওপর যে বন্দুক-আক্রমণ হয়েছিল, সে গুলি তাঁর সেক্রেটারি জেমস ব্র্যাডিকে পঙ্গু করে দিয়েছিল চিরকালের মতো। জেমস ব্র্যাডি এবং তাঁর স্ত্রী স্যারা ব্র্যাডি সারাজীবন লড়াই করেছিলেন আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য। প্রথমে জিম, এবং তার পর স্যারা মারা যাওয়ার পরে তাঁদের মারণাস্ত্র-বিরোধী আন্দোলন ধামাচাপা পড়ে গেছে অনেকটাই। আর, এখন এই মুহূর্তে আমেরিকার যিনি প্রেসিডেন্ট, তিনি তাঁর প্রত্যেক কাজের মধ্যে দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, তিনি কোনও রকম আধুনিক, বিজ্ঞানভিত্তিক, এবং জনমুখী আইকানুনের তোয়াক্কা করেন না। তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারেন যে কোনও সার্বভৌম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, তিনি রাষ্ট্রপুঞ্জকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখান, তিনি আন্তর্জাতিক পরিবেশ চুক্তিতে অন্তর্ঘাত করেন, তিনি প্রকাশ্যে বলেন, ল্যাটিনো অভিবাসীরা খুনি ও ধর্ষক, মুসলমানরা সন্ত্রাসী। এই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ন্যাশনাল মারণাস্ত্র নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী হবেন, তেমন কোনও ভরসা নেই।

আমেরিকার হিংসার ইতিহাস বহু প্রাচীন। জবরদখল করে এই মহাদেশ দখল, আদি বাসিন্দাদের নির্মূল করে দেওয়া থেকে এই ইতিহাস শুরু হয়েছিল। দুশো বছর ধরে কুখ্যাত, সভ্যতাবিরোধী দাসপ্রথা, ক্রীতদাসদের ওপর বর্বর অত্যাচার সেই হিংসাকে সামাজিক প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। এখন দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু রন্ধ্রে রন্ধ্রে আমেরিকার শাসকশ্রেণির মনে যে হিংসা ও ক্রোধের আগুন জ্বলছে, তার প্রকাশ হয় বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ ও ধ্বংসের মাধ্যমে। দেশের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের ওপর নির্বিচার পুলিশি অত্যাচার, যার বিচার এক প্রহসনে দাঁড়িয়েছে, তা দেখে লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে যায়। তার পর আছে ভয়ঙ্কর সব হিংস্র ভিডিয়ো গেম, হলিউড সিনেমা, এবং মারণাস্ত্রের নির্বিচার কেনাবেচা ও ব্যবহার। আসলে, আমেরিকায় দীর্ঘদিন না থাকলে এবং এ দেশের রাজনীতি ও সমাজে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ না করলে এ দেশের ভিতরে ভিতরে যে হিংসার চোরা স্রোত, তাকে ঠিক বোঝা যাবে না।

Advertisement

তার সঙ্গে আছে উগ্র দেশপ্রেমিক ও ধর্মান্ধ ব্যক্তিদের গা-জ্বালানো সব উক্তি। লাস ভেগাসের সন্ত্রাসের পরে ইভাঞ্জেলিস্ট টিভি ভাষ্যকার প্যাট রবার্টসন বলেছেন, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ও কর্তৃত্বের প্রতি সাধারণ মানুষের এখনকার অশ্রদ্ধাই এই হত্যালীলার জন্যে দায়ী। আপনার আমার কাছে, বা আমাদের আমেরিকান বন্ধুদের, ছাত্রছাত্রীদের কাছে এই ধরনের মন্তব্য ও বিশ্লেষণ হাস্যকর প্রলাপ মনে হতে পারে, কিন্তু অতি-রক্ষণশীল, খ্রিস্টান মৌলবাদীদের কাছে তা গ্রহণীয়, এমনকি ধ্রুবসত্য। আমেরিকার কোণে কোণে চার্চের ছড়াছড়ি, রবিবারের গির্জায় ভিড় আর লাইন,আর ধর্মের উন্মাদনা। সেই একই ধার্মিক আমেরিকানরা ট্রাম্পের মতো প্রেসিডেন্টকে ভোট দিয়ে জিতিয়ে আনেন, বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ সমর্থন করেন, জাতিবিদ্বেষ তাঁদের মনের অনেক গভীরে। মুসলমান বা হিন্দু বা বৌদ্ধ—এ সব তাঁদের কাছে বর্জনীয় শব্দ। তাঁরা বাড়িতে বাড়িতে বসার ঘরের কাচের আলমারিতে অটোম্যাটিক রাইফেল বা পিস্তল সাজিয়ে রাখেন ধর্মীয় প্রেরণায়। বিচার, বিতর্ক, বিশ্লেষণের দিন শেষ হয়েছে। এখন অন্ধতা আর যুক্তিহীন আবেগের দিন। অতিভক্তি, অতি-দেশপ্রেমের দিন। হিংসা ও ঘৃণার বৈধকরণের দিন। আমেরিকাতেও, ভারতেও।

লাস ভেগাসের ক্যাসিনোতে লক্ষ মানুষ সর্বস্বান্ত হয়। এ কথা আমরা সবাই জানি। এ বার এই বিলাসবহুল শহরের ওপর আর একটা নতুন তকমা পড়ল: এই শহরে ২০১৭ সালের ১ অক্টোবর আমেরিকার ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা ঘটেছিল। যে গণহত্যা যে কোনও সময়ে আমেরিকার যে কোনও জায়গায় ঘটতে পারে। আমরা যারা এ দেশে থাকি, আমাদের সন্তানসন্ততি থাকে, আমাদের জীবনও হঠাৎ শেষ হয়ে যেতে পারে কোনও এক খুনির রাইফেলের গুলিতে।

চার্লটন হেস্টন-এর ন্যাশনাল রাইফল অ্যাসোসিয়েশন তখনও নীরব থাকবে। তাদের পেটোয়া রাজনীতিকরাও।

(শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন