প্রতীকী ছবি।
অন্ধকার পিছনে ফেলে অনেকটা বা বেশ খানিকটা দূরে চলে এসেছি বলে যখনই মনে হয়, তখনই ফের ধাক্কা খেতে হয় অন্ধকারে। স্বস্তিদায়ক কোনও গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, এমন অনুভূতি যেই থিতু হতে চায়, তখনই ফের মাথাচাড়া দেয় ফেলে আসা অস্বস্তিটা। এ রাজ্যে বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার ছবিটা এখন অনেকটা এই রকমই। জুলুম রোগের দাপট অস্তমিত, নিরাময়ের পথে বেসরকারি হাসপাতালের অসুখ— এই বিশ্বাস যত বার দানা বাঁধতে চাইছে, তত বারই ধাক্কা খেতে হচ্ছে। আশার সৌধটা নির্মীয়মাণ অবস্থাতেই বার বার ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে।
শহরের নানা প্রান্ত থেকে প্রায় একইসঙ্গে দুঃসংবাদগুলো এল। অপ্রত্যাশিত মৃত্যু রোগীর। মৃত্যুর কারণ ঘিরে ধোঁয়াশা। ভুল চিকিৎসা অথবা ক্ষমার অযোগ্য গাফিলতির ছায়া। আর প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই রোগীর মৃত্যুর পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে অসহযোগ এবং অস্বচ্ছ আচরণ। অভিযোগগুলো অন্তত এই রকমই।
প্রত্যাশিত ভাবেই ফের উত্তপ্ত হয়েছে পরিস্থিতি। মৃতের পরিবার-পরিজনরা তীব্র ক্ষোভের নিশানা বানিয়েছেন হাসপাতালগুলিকে। রোষ আছড়ে পড়েছে বিশৃঙ্খলাকে সঙ্গী করে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোথাও ‘কান মলে’ মুখ বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন, কোথাও অভিযোগ অস্বীকার করার চেষ্টা করেছেন, কোথাও জবাব এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
এই ক্ষমা চাওয়া বা অস্বীকার করা বা জবাবদিহি এড়ানো কিন্তু আসলে মুখ লুকানোর অস্থায়ী এবং তাৎক্ষণিক কৌশল। দীর্ঘ মেয়াদের সমাধান এ সব নয়। সব পক্ষই সম্ভবত এ সত্য বুঝছে। তবু বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার ‘গভীর অসুখ’টার স্থায়ী সমাধানের পথ খোঁজার চেষ্টা হচ্ছে না।
খোদ মুখ্যমন্ত্রী আসরে নেমেছিলেন বেসরকারি হাসপাতালের ‘রোগ’ সারাতে। কোন হাসপাতালের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ, সুনির্দিষ্ট ভাবে সে সব নিয়ে জবাব চেয়েছিলেন। স্বাস্থ্য পরিষেবার নামে চিকিৎসাপ্রার্থীকে অর্থনৈতিক হেনস্থার মুখে ঠেলে দেওয়ার বিরুদ্ধে কঠোরতম স্বরে বার্তা দিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারির পরে নড়েচড়ে বসেছিল বেসরকারি হাসপাতালগুলো। রোগীর পরিজনরা যাতে অভিযোগের আঙুল তুলতে না পারেন, তা নিশ্চিত করতে বেশ তৎপরতা দেখা গিয়েছিল। দিগন্তরেখায় একটা ইতিবাচক আলো ফুটতে শুরু করেছিল। কিন্তু কয়েক মাস কাটতে না কাটতেই যেন ফের অন্ধকারের দিকেই যাত্রা শুরু।
আরও পড়ুন: ভুল ইঞ্জেকশনে ফুটফুটে এই শিশুর মৃত্যু!
এ কথা ঠিক যে অভিযোগ থাকলে তা জানানোর নির্দিষ্ট মাধ্যম রয়েছে। বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর বিরুদ্ধে আগেও বেশ কয়েক বার অনৈতিক কার্যকলাপের অভিযোগে আঙুল উঠেছে বলেই এখন যে কোনও অভিযোগ সামনে এলেই আইন হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার আমরা পেয়ে গিয়েছি, এমনটা নয়। শহরের তিন হাসপাতাল থেকে যে সব দুঃসংবাদ এসেছে, সেগুলি নিঃসন্দেহে মর্মান্তিক। কিন্তু সুনির্দিষ্ট পথে তার প্রতিকার না চেয়ে অশান্তি, নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলার মাধ্যমে প্রতিবাদ হবে, এও কাম্য নয়।
তবু দিনের শেষে বলতে হয়, এই সঙ্কটের দায় মূলত বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষেরই। প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে হুঁশিয়ারি আসার পরে বেসরকারি হাসপাতালগুলির আচরণে যে পরিবর্তন এসেছিল, সে আমরা সকলেই দেখেছি। সময় কিছুটা অতিক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই হুঁশিয়ারির প্রভাব কিয়ত্ মলিন হতেই বেসরকারি হাসপাতালগুলির সতর্ক চেহারাও যে মলিন হতে শুরু করেছে, তাও আমরা দেখছি। সমস্যা আসলে মানসিকতায়। হুঁশিয়ারির ভয়ে নয়, দায়বদ্ধতা থেকে মানবিক হওয়ার সঙ্কল্প নিতে হবে বেসরকারি হাসপাতালগুলিকে। মৌলিক পরিবর্তন তাতেই সম্ভব।