‘ধর্ম’প্রচার: কলকাতার গোলপার্ক অঞ্চলে বিজেপির উদ্যোগে অভূতপূর্ব হনুমান জয়ন্তী পালন, ৮ এপ্রিল, ২০১৭।
সুতানুটির ঘাটে কাঁচা মাটি খুঁজে পান জোব চার্নক। ক্লাইভ সেই মাটিতে সাম্রাজ্যের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এ বার সেই মাটিতেই নতুন ইমারত গড়তে চাইছেন অমিত শাহ। শত শত বছরের ইতিহাস় ডিঙিয়ে।
পথভোলা বাঙালিকে এ বার ঠিক ভারতীয়ত্বের পথ দেখাবে বিজেপি। তাই তো হনুমানজয়ন্তী, রামনবমী। জন্মাষ্টমী উৎসব এ বছর মিস হয়ে গিয়েছে, সামনের বছর করতেই হবে। রামের চেয়েও বৈষ্ণব বাঙ্গালি নাকি কৃষ্ণটা বেশি খায়। বঙ্কিমের ‘আনন্দমঠ’কে অস্ত্র করে হাতে তির-ধনুক ধরেছে বিজেপি। বাঙালির আত্মপরিচয়ের ঘুম ভাঙিয়ে পশ্চিমভারতীয় পৌরুষ নয়াদিল্লির ক্ষমতার সিংহাসন থেকে নেমে সুতানুটির ঘাটে নয়, জাহাজ ভেড়ালেন শিয়ালদহ স্টেশনে। কড়া নাড়ছেন অমিত শাহ, বাঙালি বাড়ি আছ?
সে দিন কলকাতায় অনেক দিন পর এক নেমন্তন্ন বাড়িতে দেখি, কেটারিং-এর ছেলেটি বলছে, স্যর আপনাকে একটু ভিন্ডি দিই? বাঙালি এখন ঢ্যাঁড়শ ছেড়ে ভিন্ডি খায়। ছানা না খেয়ে পনির। মাছের টক নয়, বীরদর্পে পাতে এল দই বড়া। পাঞ্জাবি নয়, নামাবলি প্রিন্টের ‘কুর্তা’ পরিহিত বাঙালি। মিশ্র খাদ্য থেকে মিশ্র সংস্কৃতি। ত্রয়োদশী জানি না, অথচ ধনতেরাস জেনে গিয়েছি। বিশ্বায়ন থেকে বাঙালির আঞ্চলিক সত্তার সম্মেলন তো রেনেসাঁস যুগ থেকে। কিন্তু এখন বাঙালিয়ানায় এসে মিশেছে হিন্দি-জাতীয়তীবাদ। হে বাঙালি, বাঙালিয়ানাকে টেকসই করার জন্য আপনি এখন রাষ্ট্র-ভক্ত? আমরা রাষ্ট্র ঋষির শরণাপন্ন। আমরা বাঙালি জাতি? নাকি হিন্দু জাতি? নাকি অখণ্ড ভারতীয় রাষ্ট্রের নাগরিক? সব গুলিয়ে যাচ্ছে।
আগে জানতাম হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্ত দু’জনের ধর্ম ভিন্ন। কিন্তু দু’জনেই কৃষক। চাষ করাই তাদের ধর্ম। বাঙালির ধর্ম জীবনযাপনের সঙ্গে যুক্ত। হিন্দু-হিন্দি–হিন্দুত্বর রাষ্ট্রবাদের স্টিমরোলার চালিয়ে বাঙালির রাজনৈতিক মুক্তি?
সে দিন বিজেপির এক রাজ্য নেতার টেলিভিশন চ্যানেলের বাইট শোনা গেল: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এত রামকৃষ্ণ-রামকৃষ্ণ বলেন, আরে বাবা, রাম আর কৃষ্ণ এই দুই মিলেই তো রামকৃষ্ণ। আমরা বিজেপি জেলায় জেলায় রাম আর কৃষ্ণের বার্তা নিয়েই তো ঘুরছি। সত্যি স্যর। এ পথেই বাঙালির রণ-রক্ত-সফলতা।
সমস্যা হচ্ছে সেকুলারবাদীরা ঠাকুরের ‘কথামৃত’ পড়েন না। হিন্দু ধর্মকে তারা হার্ভার্ড-এর অধ্যাপিকা ডায়না এক অথবা শিকাগো বিশ্ববিদ্যালযের উইন্ডি ডনিগারের কাছ থেকেই শুধু জানতে চান। হিন্দু ধর্মকে দেখতে চান শুধু নাগপুরের প্রকাশনার গবাক্ষ দিয়ে। আমি স্যর হাওড়ার এঁদো গলি থেকে এসেছি। বেঙ্গলি মিডিয়ামে পড়েছি। দেখেছি, ঠাকুর ‘কথামৃত’-এ হয়তো একশোবার হনুমানের প্রসঙ্গ তুলেছেন। কিন্তু তিনিও হনুমান–রাম-লক্ষণ-সীতাকে পুরাণের চরিত্র হিসাবেই ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ‘কথামৃত’-এ আছে, পাহাড়ের ওপর এক গরিব মানুষের পর্ণকুটির। প্রবল ঝড় উঠেছে। সে লোকটির মনে হল ঝড় হল পবনদেবতা। হনুমান তাঁর ছেলে। তখন প্রবল ঝড়ে যখন ঘর মড়মড় করে ভাঙছে তখন সে চেঁচাচ্ছে, এ হল হনুমানের ঘর, হে পবনদেবতা, এ ঘর ভেঙো না। তা-ও সে ঘর ভেঙে গেল। প্রাণে বাঁচতে সে তখন ঘর ছেড়ে পালাল। বলল, এ শালার ঘর ছেড়ে পালাও। ঠাকুর নিজে যত মত, তত পথের সহজ কথা বলে গিয়েছেন। সে তো আধুনিক দীন-ই-ইলাহি।
বাঙালিয়ানাকে বাঁচাতে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’-এর কিছু পরিচ্ছদ বেছে নেওয়া হল। দিল্লিতে বসে কিছু বিদ্বজ্জন, যাঁরা সামগ্রিক ভাবে বঙ্কিমচেতনার অন্বেষণ করেননি, কৃষ্ণচরিত্র থেকে কমলাকান্ত-মুচিরাম গুড় পড়েননি, শুধু বন্দে মাতরম্ বিতর্ক দিয়ে বাঙালিকে ‘ঔপনেবেশিক মুসলমান’ শাসনের বিরুদ্ধে নিন্দামুখর করে এক নয়া হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রকল্প গঠন করতে বাধ্য করছেন। শুধু বঙ্কিমচন্দ্র কেন, আমি তো বিজেপিকে বলব পশ্চিমবঙ্গে উনিশ শতকে বাংলার মুসলিম সমাজে শিক্ষার প্রসারের জন্য হাজি মহম্মদ মহসীনকেও তাঁরা স্মরণ করুন। হুগলি মহসীন কলেজ তো তাঁরই আর্থিক সহায়তায় স্থাপিত। হাজি মহম্মদ মহসীন নিজের সমস্ত সম্পত্তি দান করেছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালানো থেকে গরিবের চিকিৎসা অথবা পুকুর খনন, এই সবই করে গিয়েছেন সারা জীবন ধরে। আরব দুনিয়ার সমস্ত মুসলিম তীর্থক্ষেত্রে ঘুরে বাংলায় ফিরে এসে তিনি এই সব করেন। এটি একটি মনে পড়ে যাওয়া দৃষ্টান্ত মাত্র। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বাবা আশুতোষবাবু তাঁকে আঠারো শতকের শ্রেষ্ঠ ভারতীয় বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। গাঁধীজি বলেছিলেন, মুসলিমরা ঈশ্বরকে অন্য নামে ডাকেন, এই কি তাদের অপরাধ?
ধর্মীয় দিক থেকেও বাঙালি নানা ধর্ম, এমনকী হিন্দু ধর্মের মধ্যেও নানা গোষ্ঠী— বৈষ্ণব, শাক্ত, শৈব, সৌর, গাণপত সব্বাইকে নিরন্তর মেলানোর কাজ করেছেন। বিজেপি আর্যরক্ত আর বৈদিক ব্রাহ্মণ্য-হিন্দুত্বের সংস্কৃতি শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরে। ইতিহাস বলে বেদেরও রূপান্তর পর্ব আছে। ঋকবেদের রুদ্রদেবতা সংহারক। যজুঃ এবং অথর্ব পর্বে এসে তিনি শিব। তিনি শুধু ধ্বংস করেন না। তিনি শান্ত, সৃষ্টিশীল। শুক্ল যজুর্বেদের ষোড়শ অধ্যায় অনুসারে তিনিই অবৈদিক কিরাত-শবরদেরও দেবতা। তিনি যুগপৎ উচ্চ ও নিম্নবর্ণ। আর্য এবং অনার্য। বৈদিক এবং অবৈদিক। শৈবধর্মের অসংখ্য শাখা। বৈদিক, পুরানকেন্দ্রিক, তান্ত্রিক এমন বহু গোষ্ঠী বেদানুসারী না হয়েও হিন্দু ধর্মের অংশ। বেদে পুরুষ দেবতার প্রাধান্য, বেদোত্তর কালে উপজাতির মাতৃদেবীরা এসেছেন। সেখানে কালী দুর্গারই রূপ। কালীর জন্য পাঁঠাবলি হত। বাঙালিও তার ধর্মে খাদ্যাভাসে নিরামিষকে বাধ্যতামূলক কখনওই করেনি। ঠাকুর নিজে তা করতে দেননি। বিবেকানন্দ নিজে মাছরান্না করে গুরুভাইদের খাওয়াতেন। সেখানে রাষ্ট্রবাদী শৃঙ্খলায় সরকারি অনুষ্ঠানে পর্যন্ত নিরামিষ খাদ্যাভাসকে বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। গীতা প্রেস থেকে রামায়ণ সিরিয়াল, সেখান থেকে আজকের সুপারহিট ‘বাহুবলী’, পুরান-কাহিনির ফ্যান্টাসি, হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতিকে শুধু উত্তরাপথে নয়, হয়তো বাঙালিকেও প্রভাবিত করেছে। কিন্তু সেটা কি বাঙালির কাঙ্ক্ষিত জীবনদেবতার সাধনার বিপরীত প্রবণতা নয়?
হায় বাঙালি! বড় দুর্দশা আজ আমাদের। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ ছেচল্লিশের দাঙ্গা, ষাটের দশকের খাদ্য সংকট, সত্তরের দশকের বেকার সমস্যা, এ সবের ইতিহাসের বোঝা আজও আমরা বয়ে চলেছি। অথচ পশ্চিমবঙ্গের মরণ-বাঁচন সমস্যায় শিল্পায়নের পথে না হেঁটে আমরা রামনবমী আর হনুমান জয়ন্তী করে কোন ভবিষ্যতের পথে এগোচ্ছি? উত্তরপ্রদেশ থেকে প্রতি দিন সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার খবর আসছে। বাঙালিয়ানার জাতি-সত্তাও আমরা এখন বন্ধক রাখব ধর্মান্ধতার ওই রাজনৈতিক বাহুবলীদের কাছে? আবার সেই বিভাজনের রাজনীতিকেই শ্রেয় বলে গ্রহণ করব?
কমলাকন্তের মন চুরি গিয়েছিল। অধুনা বাঙালি জাতির মন ও বুদ্ধি দুই-ই কি চুরি হওয়ার উপক্রম?