শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসবে মাতোয়ারা। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে
সিপাহি বিদ্রোহ চুকেছে। রেলের লাইন পড়েছে। যাতায়াতের গতি দ্রুততর হচ্ছে। সাহেবরা রেল পাতছেন প্রশাসনের সুবিধের জন্য, সে রেলের সুবিধে ভদ্রলোক নেটিভরাও পাচ্ছেন। দ্বারকানাথের পুত্র দেবেন্দ্রনাথ মহর্ষি হয়েছেন। নিরাকার ব্রহ্মের তিনি উপাসক। নিরাকারের ধ্যান-উপাসনা প্রকৃতির মধ্যে ভাল হয়। দেবেন্দ্রনাথের কাছে তাই প্রকৃতির মনোরম ক্ষেত্রগুলিই তীর্থভূমি। তিনি ঘোরেন প্রকৃতির নানা তীর্থে। ধর্ম প্রচারও করেন, নিরাকার ব্রহ্মের উপাসক বলে বেদ-উপনিষদ তাঁর আশ্রয়স্থল। দেবেন্দ্রনাথ বীরভূমের সিংহদের বাড়িতে ব্রাহ্মধর্মের ভাব প্রচারের জন্যই এসেছিলেন। সেই ভাবপ্রচারের কাজে এসেই তাঁর এখানকার মনোরম প্রকৃতি দর্শন। শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতীর ইতিহাসকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় অনেক ভেবেও অবশ্য বুঝতে পারেননি, দেবেন্দ্রনাথ ঠিক কোন পথে বোলপুর থেকে পালকি করে জমিদার সিংহদের বাড়ি থেকে যাতায়াত করছিলেন। চালুপথে গেলে প্রাকৃতিক জমি-জিরেতের মনোরম শোভা, যা তাঁর পরবর্তীকালের শান্তিনিকেতনের ভূমি, হালের বাবু-ট্যুরিস্টদের মোচ্ছব ভূমি, দৃষ্টিগোচর হওয়ার কথা নয়। তবে দৃষ্টিগোচর হয়েছিল, ভাল লেগেছিল, জমিদার সিংহরা জমির ব্যবস্থা করেছিলেন। সেখানে শান্তিনিকেতন গৃহও ব্রাহ্মদের উপাসনার জন্য আচার্য দেবেন্দ্রনাথ স্থাপন করেছিলেন। প্রথমে তা একতলা, পরে দ্বিতল।
তবে সে গৃহ কেবল অরূপের উপাসনার গৃহ হয়ে রইল না, রূপের উৎসবের আয়োজনে মেতে উঠল। গৃহের সীমায় আটকে রইল না শান্তিনিকেতন। বলেন্দ্রনাথের ব্রহ্মবিদ্যালয়ের স্বপ্ন সেখানে পরিণতি পায়নি। বলেন্দ্র অকালে মারা গেলেন। রবীন্দ্রনাথের আদর্শ ও কল্পনা সেখানে গড়ে তুলল তাঁর শান্তিনিকেতন। এই শান্তিনিকেতনের আদিপর্বে তপোবনের আদর্শের কথা উচ্চারিত হয়, কঠোর ব্রহ্মচর্যের আদর্শ ঘোষিত হয়। ১৯০২ সালে প্রয়াত হয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। এমনিতে বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথের আদর্শে নানা পার্থক্য। অনেক চেষ্টা করেও নিবেদিতা এই দুই বাঙালির মধ্যে সহজ সখ্য স্থাপন করতে পারেননি। তবে শান্তিনিকেতনের আদিপর্বে তপোবনের ছাঁচে ব্রহ্মচর্যের আদর্শে যে ইস্কুল নির্মাণের স্বপ্ন রবীন্দ্রনাথ দেখেন ও দেখান তা বিবেকানন্দের ভাবাদর্শের সঙ্গে মিলে যায়। তবে রবীন্দ্রনাথ তো বদলাতে বদলাতে, ভাঙতে ভাঙতে অগ্রসর হয়েছেন। তাঁর চোখ কেবল অরূপের নয়, বৈরাগ্য সাধনে কেবল মুক্তি নয় তাঁর। দেবেন্দ্রনাথের পুত্র রবীন্দ্রনাথ কেবল অরূপের নন, রূপ ও অপরূপেরও। তাঁর দেখার চোখ বিরাগীর নয়, অনুরাগীর। সুতরাং শান্তিনিকেতনের মর্মে রং লাগল। রাণী চন্দ তাঁর চিত্রময় স্মৃতিকথায় গুরুদেবের বর্ণময় সজ্জার কথা লিখেছেন। প্রকৃতিতে ঋতু বদল হয়, গুরুদেবের বস্ত্রেও রং লাগে। ঋতুকে ঘিরে কবির মনের এই যে চলাচল তাই ভর করে শান্তিনিকেতনের উৎসবে, নানা সময়ে।
ইতিহাসকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথের প্রিয় পুত্র শমী ১৩১৩-র শ্রীপঞ্চমী তিথিতে ঋতু উৎসবের আয়োজন করেছিলেন। সেই ঋতুর উৎসবে কেবল বসন্ত ছিল না, বর্ষা ও শরৎও ছিল। ঋতু সাজে সজ্জিত বালকদের এই উৎসব তাই শান্তিনিকেতনের আদি বসন্তোৎসব। তবে সাল তারিখের হিসেব অপরাপর সূত্রের সঙ্গে যাচাই করলে পুরোটা না-ও মিলতে পারে। যে সময় শমীন্দ্রের এই আয়োজন সেই সময় প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনে আসেননি, এসেছেন তার বছর দুই পরে। তাঁর এই ভাষ্য তাই পরোক্ষ সূত্র থেকে নেওয়া। তবে সাল তারিখের গরমিল যা-ই হোক না কেন, শমীর এই ঋতু উৎসবের কথাটা সত্য। প্রিয় পুত্রের মতো রবীন্দ্রনাথও ঋতুময়। তাঁর ঋতুময় নাটকগুলিতে মাঝে মাঝেই ঘর থেকে প্রকৃতির আঁচলে নেমে পড়ার ডাক শোনা যায়। কাজেই শান্তিনিকেতনে ঋতু যাপনের দোলা লাগবে সে আর বলতে! তবে সেই ঋতু-যাপনে সব সময় বছরের পর বছর একই-রকম দিনক্ষণ মানা হত না। চন্দ্রাহত শান্তিনিকেতনে রাতে বসন্তের গান উঠত জেগে। চরাচর ধুয়ে যাওয়া আদিগন্ত জ্যোৎস্নায় আনন্দের জোয়ার তো লাগবেই–চাঁদের হাসির বাঁধ তো ভাঙবেই। শমীর আয়োজনের পর যে খুব ধারাবাহিক ভাবে এ উৎসব হত তা নয়, তবে যেটা বোঝা যায় শান্তিনিকেতনের আশ্রমে ঋতু উৎসব ছিল আশ্রমিকদের অংশগ্রহণের। সে উৎসবে আনন্দের প্রকাশভঙ্গির সঙ্গে নান্দনিকতার যোগ ছিল গভীর। অবশ্য এ কথাও ঠিক অনেক সময় রবীন্দ্রনাথের সময়কালেই নান্দনিকতার মাত্রা অনান্দনিকতার দিকে ঝুঁকে পড়ত। অন্তত কারও কারও চোখে আনন্দ প্রকাশের সেই চেহারাটি কটু লাগত। পঞ্চানন মণ্ডলেরই যেমন ভাল লাগেনি কোনও কোনও ঘটনা। তবে সব মিলিয়ে ক্রমশই শান্তিনিকেতনে আশ্রমিকদের মধ্যে ঋতু উৎসবের সহজ রূপটি পালনের আনন্দময় দিনক্ষণ স্থির হয়ে গিয়েছিল।
শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসবে প্রভাত ফেরি। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে
তবে রূপ দেখার ও অংশগ্রহণের শিক্ষা যে সবার থাকে তা তো নয়। বিশেষ করে যখন অংশগ্রহণের বদলে পয়সা খরচ করে দেখার বাসনা মুখ্য হয়ে ওঠে তখন মত্ততার পালে হাওয়া লাগে। ইতিহাসের পুরনো ক্রম অনুসরণ না করে এ কথা বলাই যায়, দোলে শান্তিনিকেতনে যাওয়া এখন সাংস্কৃতিক প্যাকেজ। এই প্যাকেজ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। আম বাঙালি শান্তিনিকেতনে নিমজ্জিত, ছোট শহরের নাভিশ্বাস উঠতে বাধ্য। গাছের গায়ে হাত পড়ে, রাস্তা জ্যামজমাট হয়। নিভৃতি উধাও। সেই প্যাকেজে পুঁজি ও দেখনদারিত্ব মুখ্য। আশ্রমের নিজস্ব উৎসবকে বাইরে থেকে এসে দেখার লাগ-ভেলকি-লাগে মন দিলে আর যাই হোক শান্তিনিকেতনের প্রকৃতিকে স্পর্শ করা যায় না। তবু পর্যটনপুঁজির যুক্তি মেনে এ তো চলবেই। শুধু মনে হয় যদি পরিবেশ-পরিস্থিতিকে খানিকটা সহনীয় করার জন্য পর্যটকেরা একটু যদি সচেতন হন! নিভৃতিকে যদি নষ্ট না করেন! আর বসন্তের একটা দিনে হাজিরা না দিয়ে নিজেদের মতো করে নীরবে বসন্ত প্রকৃতিকে স্পর্শ করে চলে যান তা হলে তাঁদের মনে বসন্তের রং ঠিকমতো লাগতে পারে। ইচ্ছে হলে প্রমত্ত অবস্থায় কাদা মেখে হোলি খেলা যায় বটে তবে উৎসব মানে যে প্রমত্ততা নয় সে কথাই তো রবীন্দ্রনাথ বোঝাতে চেয়েছিলেন। সেটুকু বোঝার চেষ্টা করলে মন্দ হয় না।
(লেখক বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক)