ভিড়ের মধ্যেও কাউকে কাউকে আলাদা করে চেনা যায়। যায় তাঁদের আকাশচুম্বী উচ্চতার জন্য, তাঁদের দিগন্তস্পর্শী উদারতার জন্য, সুদূরপ্রসারী দৃষ্টির জন্য। নিজেকে আলাদা করে চেনানোর তাগিদ অবশ্য অনেকেরই থাকে। উচ্চতার অভাবটা তাঁরা পূরণ করতে চান অন্য সহজলভ্য পথে।
যেমন এই মুহূর্তে চলছে গোহত্যা নিবারণী সঙ্কল্পের গৈরিক ঘোষণাকে কেন্দ্র করে। উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ যদি অবৈধ কসাইখানা বন্ধের নির্দেশ দিয়ে পাদপ্রদীপের আলোটুকু শুষে নেন, তা হলে অন্যেরাও বা পিছিয়ে থাকেন কেন? সামনেই ভোট আসছে গুজরাতে, অতএব আইন পাল্টে গোহত্যার দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান হয়ে গেল। ছত্তীসগঢ়ের সর্বাধিনায়ক রমন সিংহ আরও এক ধাপ এগিয়ে গোহত্যার শাস্তি ফাঁসি বলে ঘোষণা করে দিলেন।
নিজ শিবিরেই প্রথম সারিতে থাকার লক্ষ্যে পরস্পরকে টপকে আরও কঠোর বিধান ঘোষণার এই প্রতিযোগিতায় একটা বড় বিপদের আবাহন রয়েছে, এই সহজ সত্য যাঁরা বুঝতে অস্বীকার করছেন, তাঁরা ভাবের ঘরের বাসিন্দা। এই দেশ তার বিবিধতাকে ধর্ম-বর্ণ-জাতি-ভাষার মতো খাদ্যাভ্যাসেও লালন করে এসেছে বহু শতাব্দী ধরে। সেই অভ্যাস, সেই চর্চার মধ্যে স্বাধীকারের অঙ্গীকারও থাকে, থাকে বহু স্রোতের মধ্যেও স্বকীয় ধারাটি বহমান রাখার প্রয়াস। বহুত্ববাদের চর্চায় এই সত্যটি অস্বীকার করলে বড় ভুল হবে।
বস্তুত, এই সত্যটির অস্তিত্ব সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল থাকার কারণেই বিজেপি-ও উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে গোনিধন প্রসঙ্গে সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ অবস্থান নিয়েছে। গোহত্যার বিরুদ্ধে বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীদের যে সব যুক্তি, তা উত্তর-পূর্বে প্রযোজ্য নয় কেন? কারণ, সেখানে অনেক রাজ্যেই খাদ্যাভ্যাসে গোমাংস অঙ্গীভূত একটা বড় অংশের জনসংখ্যার মধ্যেই। তা হলে কি অর্থটা এটাই দাঁড়াল, যাবতীয় সিদ্ধান্ত ও ভাবনার স্রোত বইবে অধিকাংশের জীবন-ভাবনা-অভ্যাসের অনুযায়ী? সংখ্যাগুরু যেমন চাইবে, তেমনটাই হবে?
মানসিকতা যদি তাই হয়, তবে গণতন্ত্রের পক্ষে ঘোর দুর্দিন। সংখ্যালঘুর অধিকার এবং জীবনচর্যা যদি নির্বিঘ্ন ভাবে সুনিশ্চিত না করা যায়, তবে গণতন্ত্রের সংজ্ঞাতেই আঘাত এসে পড়ে। অনেক মতের, অনেক অভ্যাসের স্ককীয় বহতা স্রোতের মধ্যে আমাদের দেশের মহান অস্তিত্ব, আমাদের শক্তির ভিত্তি— এই কথাটি ভুললে আপাতত প্রথম সারির দৌড়ে কিছু হাততালি পাওয়া যাবে, কিন্তু ইতিহাসের কাছে ক্ষমা পাওয়া যাবে না।