পুজোর থিম মানসিক রোগ!

কিন্তু এমন ‘থিম’ মণ্ডপে লাইভ শোয়ের মাধ্যমে উঠে-আসা মনোরোগী সকলের কাছে হাসির খোরাক, ভয়ের বীজ হয়ে উঠছেন। প্রতিবন্ধী যখন প্রদর্শনীর বিষয়, তখন সেই ব্যক্তির মধ্যে মানবমন, মনুষ্যজীবনের বহুমাত্রিকতা চলে যায়।

Advertisement

রত্নাবলী রায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share:

কালীপুজোয় মানসিক হাসপাতালকে ‘থিম’ করেছে, এমন দু’টি ক্লাবকে নিয়ে হইচই পড়েছে সংবাদ আর সমাজমাধ্যমে। একটি নদিয়ার ধুবুলিয়ায়, অন্যটি কলকাতার মুকুন্দপুরে। মন্দির, মসজিদ কিংবা অন্যান্য স্থাপত্য ছাপিয়ে যে ক্লাবের কর্তারা এমন একটি বিষয় বেছে নিয়েছেন তার জন্য অভিনন্দন। মানসিক হাসপাতাল যে অচ্ছুৎ রইল না, জনপরিসরে উঠে এল, এটা আনন্দের খবর বইকি।

Advertisement

কিন্তু কী দেখা যাচ্ছে সেখানে? মুকুন্দপুরের মণ্ডপ দেখে এসে এক জন পোস্ট করেছেন, “দুপাশে সারি সারি খোপ, এক একটি খোপে আলো জ্বলে উঠছে, একে একে দেখা যাচ্ছে প্রেমিক পাগল, তান্ত্রিক পাগল, অর্থনাশ পাগল, দেশপ্রেমিক পাগল, নেতা পাগল।” অর্থাৎ মানসিক হাসপাতালে যে শুধু ‘ব্রেন শর্ট’-এর জন্য যেতে হয় না, তার রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক কারণও থাকে, তা বোঝা যাচ্ছে। সেটা চমৎকার। ধুবুলিয়ায় দেখা গিয়েছে গারদের মধ্যে কিছু মানুষ গড়াগড়ি খাচ্ছেন, চিৎকার করছেন, পরনে ছেঁড়া জামাকাপড়, আলুথালু, নোংরা, একমুখ দাড়ি। ভিডিয়োতে শোনা যাচ্ছে এক জন চিৎকার করে বলছেন, “আমার বাবার নাম কালু, আমি কালুর ছেলে, বাবার নাম কালু!” একটা হাহাকার। কেউ কাঁদছেন, কেউ হাসছেন। মানসিক হাসপাতালে বন্দি রোগীর অসহায়তা, সংসার-সমাজকে ছেড়ে থাকার যন্ত্রণাও উঠে এল। এই যন্ত্রণা অত্যন্ত বাস্তব।

কিন্তু এমন ‘থিম’ মণ্ডপে লাইভ শোয়ের মাধ্যমে উঠে-আসা মনোরোগী সকলের কাছে হাসির খোরাক, ভয়ের বীজ হয়ে উঠছেন। প্রতিবন্ধী যখন প্রদর্শনীর বিষয়, তখন সেই ব্যক্তির মধ্যে মানবমন, মনুষ্যজীবনের বহুমাত্রিকতা চলে যায়। তখন সে হয় ভাঁড়, নয় উন্মাদ খুনি। সিনেমাতেও এমনই হয়। বাংলায় ‘স্বয়ংসিদ্ধা’ ছবিতে স্বামীর চরিত্রটি মনে পড়ে, যার অভিনেতা ছিলেন রঞ্জিত মল্লিক?

Advertisement

কেন মনোরোগীদের দ্রষ্টব্য বস্তু করে তুলতে হয়? সহজ উত্তর, ‘স্বাভাবিক’ বা ‘নর্মাল’ কী, সে বিষয়ে আমাদের ধারণা ও বোধ আমরা সবার উপর চাপাতে চাই। কখনও ভাবি না, এই স্বাভাবিকতার ধারণা প্রয়োগ করে আমরা শাসন-পীড়ন চালিয়ে যাই তাঁদের উপর, যাঁরা এই ধারণার আওতায় পড়েন না। ইংরেজিতে একে বলে ‘টিরানি অব নর্মালসি’ বা স্বাভাবিকতার স্বৈরতন্ত্র। যে আলাদা, ভিন্ন, তাকে ‘অস্বাভাবিক’ মনে করলে তাকে কোনও খোপের মধ্যে পুরে, দূর থেকে তাকে দেখে হাসা যায়, বা ভয় পাওয়া যায়। এগুলো দিব্যি স্বাভাবিক মনে হতে থাকে। এটা এক ধরনের সংস্কৃতি, এবং রাজনীতিও বটে, যা সমাজের প্রচলিত ছকগুলোকে ধরে রাখে, কোথাও ভিন্নতার জায়গা তৈরি করতে দেয় না। এই মণ্ডপগুলো যাঁরা দেখবেন, তাঁদের মনে হতেই পারে, “ও বাবা, পাগলদের থেকে দূরে থাকতে হয় এবং সবাইকে দূরে রাখতেও হয়!”

কলকাতার মুকুন্দপুরে উঁচু দেওয়াল-ঘেরা মণ্ডপ তৈরি হয়েছিল, সামনে ফলকে লেখা ‘সেন্ট্রাল মেন্টাল ইনস্টিটিউট’। অত বড় পাঁচিল কেন? মানসিক হাসপাতাল কি জেল? রোগী কি অপরাধী? অথচ আমরা তো এখন মনোরোগীদের ব্রাত্য না করে সমাজের দৈনন্দিন কাজে-উৎসবে টেনে আনা, সঙ্গে নেওয়ার কথা বলি। মনোরোগী বিপজ্জনক, এই পুরনো ধারণা মোটেই ধোপে টেকে না। কিছু মানসিক রোগীকে কিছু সময়ের জন্য হাসপাতালে থাকতে হয়, যে কোনও রোগেই চিকিৎসা করাতে যেতে হয় হাসপাতালে। তা বলে তাঁরা গরাদবন্দি থাকবেন কেন? মানসিক স্বাস্থ্য আইন বলছে, যথাসম্ভব খোলামেলা রাখতে হবে রোগীদের। যত খোলামেলা পরিবেশ তত দ্রুত আরোগ্য।

আর সত্যিই মনোরোগীদের হাসপাতাল এখন আগের চাইতে খোলামেলা। নানা সরকারি মানসিক হাসপাতালে দেখা যায়, বাসিন্দারা চত্বরের মধ্যে সব্জি বাগান, ফুলের বাগান করছেন, মাছ চাষ করছেন। তাঁরা ক্যান্টিন চালাচ্ছেন, যেখানে খাওয়াদাওয়া করেন রোগী দেখতে-আসা আত্মীয়েরা। নিজেদের চাদর, জামাকাপড় সাফ করতে তাঁরা অত্যাধুনিক লন্ড্রি চালাচ্ছেন। চালাচ্ছেন একটি বেকারি, যেখানে তৈরি হচ্ছে কেক, পাঁউরুটি। অনেকে নিয়মিত নাচ-গানের চর্চা করেন, বিশেষ দিনে অভ্যাগতদের সামনে মঞ্চে অনুষ্ঠানও করেন। তাঁরা তৈরি করছেন অপরূপ কত হস্তশিল্প— পোড়ামাটির পাত্র, ব্লক প্রিন্টের কাপড়। এমন কত কিছুই না হচ্ছে।

তাই পুজোর মণ্ডপের মধ্যে বন্দি রোগী দেখালে ভুল হয়ে যায়। আইন বদলে গিয়েছে, হাসপাতাল, চিকিৎসাও বদলাচ্ছে, কিন্তু সমাজ কেন এগোতে পারছে না? কেন ‘স্বাভাবিকতার সংস্কৃতি’ তৈরি করবে মনোরোগীর সঙ্গে দূরত্ব?

মণ্ডপগুলির ভিডিয়ো ভাইরাল হওয়ার পর সমাজমাধ্যমে অনেকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, এটা আশাব্যঞ্জক। তা বলে আমরা কি ক্লাব সদস্যদের শাস্তি দেব? না। বরং আমন্ত্রণ করব। ক্লাব সদস্যরা কলকাতার কিংবা জেলার মানসিক হাসপাতালে আসুন, আবাসিকদের হাতে তৈরি চা, ঘুঘনি খেতে খেতে তাঁদের সঙ্গে আড্ডা দিন। ধারণা বদলাবে। এ ভাবেই ‘স্বাভাবিকতা’ তৈরির সংস্কৃতির পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন