আজ থেকে বছর বিশেক আগে ১৯৯৯-এর ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার অধিকারের জন্য পূর্ববাংলার বাঙালি তরুণদের আত্মত্যাগ স্মরণ করে এই দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করে। তার পর নতুন শতাব্দী এল, পেরিয়ে গেল বছর কত! বাংলাদেশে রাষ্ট্রপুঞ্জ মহাসচিবের উপস্থিতিতে উদ্বোধন হল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। তবু বাংলাদেশ, ভারত-সহ ইউনেস্কোভুক্ত দেশগুলোতে মাতৃভাষার প্রচলন, সংরক্ষণ ও বিকাশে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে?
আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা সংক্রান্ত উদ্বেগের কথাই ধরি। যে ভাষা-আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির লড়াইয়ে সাত দশক আগে রাঙা হয়েছিল বাংলার অশোকপলাশ, সে ভাষা-আগ্রাসন কী আমরাও করছি না বাংলায় বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা-অধিকারের ক্ষেত্রে? এ অঞ্চলের আদিবাসী সাহিত্যিকদের অনেকেই তাঁদের সাহিত্যের ভাষা হিসেবে মেনে নিয়েছেন বাংলাকে। অথচ আদিবাসী কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকারের লেখা যদি স্বভাষায় অনূদিত না হয় তবে তাতে নিজের যথার্থ প্রকাশ ঘটে কি? প্রয়াত কথাশিল্পী আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লিখেছিলেন ‘চাকমা উপন্যাস চাই’ নামে একটি প্রবন্ধ। ‘‘আমার কেবলই মনে হচ্ছে চাকমা শিল্পীর লেখা চাকমা ভাষার উপন্যাস চাই; সেই উপন্যাসের বেশির ভাগ লোক চাকমা, তাদের বাড়ি রাঙামাটি কী খাগড়াছড়ি কী সুন্দরবনের কোনো পাহাড়ি জনপদে, তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের সঙ্গে তাদের বঞ্চনা, অপমান ও প্রতিরোধ এমন মিলেমিশে থাকবে যে একটি থেকে আরেকটি আলাদা করা যাবে না।...’’ অর্থাৎ ইলিয়াস চেয়েছিলেন, একটি জনগোষ্ঠীর ভেতর থেকে স্বভাষায় তার অকথিত আখ্যান উঠে আসুক, যেমন ঘটেছে আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকায়।
এ তো গেল সাহিত্যের কথা। উচ্চশিক্ষার জন্য আদিবাসী তরুণ-তরুণীরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসছেন, বাধ্য হয়ে উচ্চতর জ্ঞানের বাহন হিসেবে বেছে নিচ্ছেন পরভাষা। সঙ্কটটা এমন যে বিলুপ্তপ্রায় বহু ভাষাগোষ্ঠীর তরুণ-তরুণীরা নিজের এবং নিজ গোত্রের ভাগ্যবদলের মানসে শিক্ষা বা কর্মসূত্রে রাজধানী বা বড় শহরগুলোতে এসে নিজেদের প্রতিষ্ঠার জন্য পরভাষী হয়ে উঠছেন। এতে তাঁদের ব্যক্তিপ্রতিষ্ঠা সহজ হচ্ছে। কিন্তু তাঁদের জনগোষ্ঠী ক্রমশ ভাষাসংখ্যালঘুতা বা ভাষাবিলুপ্তির পর্যায়ে পতিত হতে থাকে। এই সঙ্কট বিশ্ব জুড়েই।
আদিবাসী ভাষাগোষ্ঠীর বিষয় থেকে আসা যাক বাংলা ভাষা প্রসঙ্গে। যে বাংলার জন্য এত লড়াই, রক্ত ও অশ্রুপাত, সেই ভাষার ব্যবহারই আমরা কতটা সচেতন? শতবর্ষীপ্রায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন-বিজ্ঞপ্তিতে যখন ‘উপ-উপাচার্য’ না লিখে লেখা হয় ‘প্রো-উপাচার্য’, তখন বুঝতে হয় ইউনেস্কোর স্বীকৃতি দিয়ে আমাদের মাথা থেকে ভাষা-উপনিবেশের ভূত তাড়ানো কঠিন। নানা কাজে কলকাতায় গিয়ে দেখেছি হোটেলবয় থেকে ট্যাক্সিচালক পর্যন্ত সকলের সঙ্গে অশুদ্ধ হিন্দিতে কথা বললে যতটা সমীহ পাওয়া যায় কিংবা যত সহজে কার্যোদ্ধার হয়, শুদ্ধ বাংলায় তা হয় না। এই কি বিদ্যাসাগর রবীন্দ্রনাথ নজরুল জীবনানন্দের ভাষাভূমির পরিণতি?
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে ভাষা-সঙ্কটের চেহারায় স্বাতন্ত্র্য আছে ঠিকই, তবে মিলও কম নয়। ইংরেজি ও ধর্মীয় মাধ্যমের শিক্ষালয়ের শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ যে ভাবে ‘মাতৃভাষা রূপখনি পূর্ণ মণিজালে’র বোধ থেকে বঞ্চিত ভাবে বড় হচ্ছে, তাতে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা জাগে বইকি।
দু’চারটে আশার কথাও আছে অবশ্য। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। ঢাকায় আমার অফিস সহায়ক মুঠোফোনে বার্তা বিনিময় করতে শিখেছে এই সবে। কিন্তু তাকেও দেখছি ফোনে খুদেবার্তা পাঠাতে গিয়ে রোমান হরফ ব্যবহার না করে অনেকটা সময় দিয়ে বাংলায় বার্তা প্রেরণ করতে। সে বলে, মাতৃভাষা-শহিদদের প্রতি সম্মান জানাতেই তার এই অভ্যাস রপ্ত করা। অনেক সংবাদকর্মীকে দেখি কোনও ইংরেজি শব্দের সম্ভাব্য বাংলা প্রতিশব্দটি আবিষ্কার ও ব্যবহারের চেষ্টায় কত সময় দেন।
সাহসী গল্পও আছে। প্রচল স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের এক বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন গত আট বছরে বাংলা ভাষায় আট হাজার রায় ও আদেশ লিখেছেন। বাংলায় আইনি পরিভাষার ব্যবহার অধিকতর জটিল ভাবেন অনেকেই। কিন্তু এই বিচারপতি তাতেও উতরে গিয়েছেন। কোয়াশমেন্ট মানে ‘অবমোচন’, বেনিফিট অব ডাউট-কে করেছেন ‘সন্দেহের সুবিধা’, নন-স্পিকিং অর্ডার-কে তিনি করেছেন ‘অব্যাখ্যাত’। যাঁরা বলেন যে, ইংরেজি থেকে বাংলা করলে অনেক সূক্ষ্ম বিষয় হারিয়ে যায়, তাঁদের জন্য বিচারপতি জাকির হোসেনের উত্তর— ইংরেজি আইনের আজ যে ‘বাহাদুরি’, সেটা তো রোমান ও লাতিন পরিভাষাগুলো থেকে দেদার ঋণ করেই। বাংলারও সেই চেষ্টা করে যেতে হবে। আর তেমনই, বাংলার ঋণ মেনে নিয়েই অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠীর মানুষকেও বাংলার পাশে নিজের নিজের ভাষার দীপটি জ্বালাতে হবে। নয়তো, ভাষাদিবস অর্থহীন।