ঝাড়ু হাতে মেঝেতে দেশের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রীর অতীত কাহিনি। এমনই এক ছবি বছর চারেক আগে ছেয়ে গিয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়া। সে সময় পেরিয়ে এসেছি। অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি নিত্য নতুন কেতাদুরস্ত পোশাকে, স্টাইল স্টেটমেন্টে পারদর্শী প্রধানমন্ত্রীর দেশবিদেশের ছবিতে। যেন একটা স্বপ্নের উড়ান। গোটা দেশের আশা পূরণের এক নয়া ইমেজ, এক লহমায় অবহেলা, বঞ্চনা থেকে সাফল্যের চওড়া হাসিমুখ। এই দুই স্টাইলের মাঝে ছড়িয়ে আছে নানা ঝাঁ-চকচকে পরিকল্পনার দৃশ্যমান বয়ান। হোক না তা সিঙ্গাপুর, পশ্চিম এশিয়ার বা মার্কিন মুলুকের মসৃণ হাইওয়ে অথবা সুদীর্ঘ ক্রস-কাটিং উড়ালপুলের কাটাছেঁড়া করা আরও কিছু ছবির প্রদর্শনী। সত্য, অসত্য আর অর্ধসত্যের মিশেল এই স্বপ্নপূরণ।
এই ছবি সংবলিত বয়ানগুলিই বাস্তব। ছবি আর বয়ান মিলেই তৈরি হচ্ছে মেসেজ, ছড়িয়ে পড়ছে ইনফো-হাইওয়ের সৌজন্যে, অতি দ্রুততায়। তথ্য আর বার্তা নিয়ে কি আপনার মনে কোনও সন্দেহ হচ্ছে? তথ্যসমৃদ্ধ বিশ্ব পার করে এখন যে শুধু গালভরা পোস্ট-ট্রুথের জমানা। বিভ্রম যদি হয়ে ওঠে বাস্তব— তথ্য নয়, যুক্তি নয়, স্রেফ আবেগ নিয়ে মেসেজ পড়া যাবে তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যেই। নয়া প্রযুক্তির সাহায্য নিয়েই পাল্টে দেওয়া যেতে পারে আধুনিকতার যুক্তি-তর্কের ইমারতকে।
তথ্য নয়, বিকল্প তথ্য; নিউজ় নয়, ফেক নিউজ়ে আক্রান্ত এই সময়। এ দেশের অভিজ্ঞতায় ফেক নিউজ় বা ভুয়ো খবর কয়েক বছর আগে ধরা দিলেও, ২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফেক নিউজ়ের বাড়বাড়ন্তে টনক নড়ে সকলের। ভুয়ো খবর পাক খেতে থাকে— সে হিলারি ক্লিন্টনের আইএসআই’কে অস্ত্র বিক্রি করার খবরই হোক বা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পোপ ফ্রান্সিসের অনুমোদনের। অসত্য তথ্য প্রচারের থেকেও ক্ষতিকারক এই ফেক নিউজ়, কারণ বিকৃতির মাধ্যমে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে তৈরি করা হয় কোনও শাসনব্যবস্থার সপক্ষে বা বিপক্ষে জনমত বা ব্যক্তিবিশেষের উপর আনুগত্য। এর প্রভাব অভূতপূর্ব। দেশ-সমাজের সীমানা অতিক্রম করে, এক মিডিয়া থেকে অন্য মিডিয়ায় তার সাবলীল ভাইরাল চলাচল। এমনকি এই ফেক নিউজ়ের নিপুণ কারসাজিতেই তৈরি হচ্ছে ব্যক্তিগত অপব্যবহারের সম্ভাবনা।
ইন্টারনেট-পূর্ব সময়ে ছিল ওয়ার্ডস অব মাউথ, মুখে মুখে গুজব ছড়ানোর ধারা। সমাজের মূলস্রোতের সীমান্তে চোরাগোপ্তা পছন্দ-অপছন্দের প্রতিনিধিত্ব করে কিছু বিশ্বাস অথবা সন্দেহমূলক তথ্য মুখে মুখে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল জনমতকে প্রভাবিত করা। এই অনিশ্চয়তা থেকেই লোককথা হয়ে ওঠে লোকগাথা। ১৯৪৯ সালের ২২-২৩ ডিসেম্বর মাঝরাতে কারা কেন রামলালার মূর্তি বাবরি মসজিদে রেখে এল, সে তথ্যের চেয়ে রামজন্মভূমির সমষ্টিগত ভাবাবেগ ক্রমে মান্যতা পেয়েছে আধুনিক ভারতে।
ডিজিটাইজ়ড দুনিয়ায় আগেকার যুগের গুজবের জায়গাটা নিয়ে নিয়েছে ফেক নিউজ়। এই দুইয়ের মধ্যে ফারাকও আছে। গুজব উস্কে দিতে পারত বিতর্ক, গুজব-বৃত্তান্ত নিয়ে পারস্পরিক ব্যাখ্যারও কিছুটা সুযোগ ছিল। প্রামাণ্যতার যুক্তি নিয়ে চলতে পারত দাবি, পাল্টা দাবি। সেখানে একতরফা প্রমাণের প্রকল্প নিয়ে অবিরত ছড়িয়ে পড়ছে ফেক নিউজ়। সব চেয়ে কার্যকর ভূমিকা সেখানে দৃশ্যমান মেসেজের। শুধুমাত্র সমমনস্ক সমগোষ্ঠীর মধ্যে ফেক নিউজ় ‘ইকো-চেম্বার’ গড়ে তোলে না। উল্টে তৈরি করে এক ক্রমবর্ধমান ভার্চুয়াল জনগোষ্ঠী।
ফেক নিউজ় যেমন হাসির খোরাক হতে পারে, অন্য দিকে ঠিক তেমনই মারাত্মক বিদ্বেষের প্ররোচনা দিয়ে সামাজিক স্থিতি নড়িয়ে দিতে সক্ষম এই ভুয়ো খবর। এক দিকে যেমন নোটবন্দি পর্বে নতুন নোটে ‘ন্যানো জিপিএস’ চিপস খোরাক হয়ে যায়, অন্য দিকে বিদ্বেষমূলক হোয়াটসঅ্যাপে ছবি ছড়িয়ে ধর্মান্ধরা রাজধানী শহরের একটু দূরে দাদরি গ্রামে নৃশংস হত্যা করে মহম্মদ আখলাককে। আর, সম্প্রতি একের পর এক নিরীহ ব্যক্তিকে গণপ্রহারে হত্যা করার ঘটনাগুলি তো আমরা জানছিই। শিশুপাচারের ভুয়ো সংবাদ অথবা ফেক নিউজ় বিষয়ে গ্রামগঞ্জের মানুষকে কী করে সচেতন করে তোলা যায়, এখনও কেউ তার পথ জানে না।
(চলবে)
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সমাজতাত্ত্বিক