অচলাবস্থা

‘আমি অর্থনীতির পণ্ডিত নহি’ বলিবার পিছনে মনমোহন সিংহকে ব্যঙ্গ করিবার বাসনা ছিল, তাহা বলিবার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু ব্যঙ্গের অন্য উপায়ও তো ছিল! এবং, তাঁহার বুধবারের বক্তৃতাটি আগাগোড়াই বাঁধা ছিল সমালোচনার জবাব দিবার সুরে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৭ ০১:২১
Share:

নরেন্দ্র মোদীর মুখে বিনয়? ‘আমি অর্থনীতির পণ্ডিত নহি’ বলিবার পিছনে মনমোহন সিংহকে ব্যঙ্গ করিবার বাসনা ছিল, তাহা বলিবার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু ব্যঙ্গের অন্য উপায়ও তো ছিল! এবং, তাঁহার বুধবারের বক্তৃতাটি আগাগোড়াই বাঁধা ছিল সমালোচনার জবাব দিবার সুরে। সমালোচনার প্রধান বক্তব্য: ভারতীয় অর্থনীতি বিপাকে পড়িয়াছে, এবং উঠিবার লক্ষণ নাই। বিভিন্ন মহলের এই সমালোচনায় নূতন ইন্ধন দিয়াছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। তাহারা অগস্ট মাসে বলিয়াছিল, ২০১৭-১৮ সালে আয়বৃদ্ধি হইবে ৭.৩ শতাংশ, এখন বলিতেছে সেই হার দাঁড়াইবে ৬.৭ শতাংশ। অর্থাৎ, অর্থনীতি দৌড়াইতেছে, এমন কথা বলিবার কোনও উপায় নাই। এবং তাহার সঙ্গে সঙ্গে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বলিয়াছে, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে সরকারি খরচে লাগাম টানিয়া রাখা দরকার, অর্থাৎ রাজকোষ হইতে টাকা ঢালিয়া অর্থনীতির বৃদ্ধিতে নূতন উৎসাহ দেওয়াও যুক্তিযুক্ত হইবে না। এই কারণেই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার কমায় নাই, কারণ সুদের হার কমিলে বাজারে ঋণের জোগান বাড়ে, তাহার তাড়নায় মূল্যবদ্ধির হার স্ফীত হইবার আশঙ্কা। এক কথায়, আয়বৃদ্ধির গতিভঙ্গ এবং মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা— অর্থনীতি এই উভয়সংকটে পড়িয়াছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতামালায় সেই সংকট দূর হইবে না। সম্ভবত এই কঠিন সত্য বুঝিয়াই প্রধানমন্ত্রী পিছনের পায়ে ভর দিয়া খেলিতে তৎপর।

Advertisement

এই পরিস্থিতির জন্য তাঁহার নিজের দায়িত্ব কম নহে। সত্য ইহাই যে, অর্থনীতির উন্নতিকল্পে প্রধানমন্ত্রী যত গর্জাইয়াছেন, তাঁহার সরকার তাহার সিকিভাগও বর্ষায় নাই। নোট বাতিলের ধাক্কাটি অর্থনীতি সামলাইয়া উঠিতে পারে নাই। বাজারে চাহিদার যে ক্ষতি হইয়াছে, তাহাতে নূতন বিনিয়োগের পক্ষে কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ খাড়া করা মুশকিল। কর্মসংস্থানের যে প্রতিশ্রুতি তাঁহারা দিয়াছিলেন, প্রকৃত সংখ্যা তাহার ধারেকাছেও পৌঁছায় নাই। ফলে, এক দিকে শুইয়া পড়া অসংগঠিত ক্ষেত্র, আর অন্য দিকে কর্মসংস্থানের গতিহীনতা, দুইয়ে মিলিয়া বাজারের চাহিদাকে সংকুচিত করিয়াছে। সেই ধাক্কা সামলাইবার পূর্বেই অপরিকল্পিত জিএসটি আসিয়া আরও এক দফা ক্ষতি করিয়াছে। প্রধানমন্ত্রী ছাতি ফুলাইয়া মেক ইন ইন্ডিয়ার কথা বলিয়াছেন, কিন্তু বিশ্ব বাজারে রফতানির উপর নির্ভর করিয়া অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির বৃদ্ধি ঘটাইবার যে মডেল চিন সফল ভাবে ব্যবহার করিয়াছিল, তাহার দিন গিয়াছে। ফলে, মেক ইন ইন্ডিয়াও কথামাত্রসার হইয়াছে। স্টার্ট আপ ইন্ডিয়া-র অবস্থাও তথৈবচ। অর্থাৎ, সরকার এক দিকে বাজারের চাহিদাকে ধ্বংস করিয়াছে, আর অন্য দিকে বিনিয়োগ আসিবার নূতন দরজাগুলি খোলে নাই। ভারতীয় অর্থনীতি যে থমকাইয়া যাইবে, তাহাতে আর সংশয় কী?

রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার আরও কমাইলেও সুবিধা হইবে না। এখন দেশের বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির হাতে বিপুল পরিমাণ নগদ আছে। তাহারা নিজেদের তাগিদেই ধার দিতে চাহে। সমস্যা হইল, ঋণ লইবার উৎসাহ নাই। কারণ, বিনিয়োগের পরিসর নাই। বস্তুত, গত এক বৎসরে দেশের মোট উৎপাদনক্ষমতার সিকি ভাগ অব্যবহৃতই প়়ড়িয়া আছে। নূতন বিনিয়োগ হইবে কোথায়? অতএব, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রত্যাশায় না থাকিয়া সরকার উদ্যোগ করুক। বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি হউক। ভারতীয় অর্থনীতি আপাতত সরকারি ব্যয়ের ভরসাতেই চলিতেছে। তাহাই যদি হয়, তবে দুইটি ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে নজর দেওয়া বিধেয়। এক, পরিকাঠামো নির্মাণ; দুই, গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনা। মানুষের হাতে টাকা আসিলে তবেই চাহিদা তৈরি হইবে। আর, বাজারে চাহিদা বাড়িলে তবেই বিনিয়োগ বাড়িবে। সুদের হারের মুখ চাহিয়া বসিয়া থাকা অর্থহীন।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন