আপাতত চিকিৎসা

প্রচারপত্র হিসাবে দেখিলেও এই ইস্তাহারকে গুরুত্ব দিতে হয়, কারণ তাহা স্পষ্ট ভাষায় ভারতীয় রাজনীতি এবং রাষ্ট্রনীতিকে একটি সুস্থ পরিবেশ ও উদার অগ্রগতির পথে ফিরাইবার কথা বলিয়াছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০১
Share:

ছবি পিটিআই।

ভোটের ইস্তাহারকে রাজনৈতিক দলের আন্তরিক প্রতিশ্রুতি এমনকি প্রকৃত ইচ্ছাপত্র মনে করিলেও সরল মনের পরিচয় দেওয়া হয়। সারল্য ক্ষেত্রবিশেষে নির্বুদ্ধিতার নামান্তর। কিন্তু ইস্তাহারকে পত্রপাঠ (বা বিনা পাঠেই) অর্থহীন বলিয়া উড়াইয়া দেওয়াও বুদ্ধির পরিচায়ক নহে। সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের জন্য ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস যে ইস্তাহারটি মঙ্গলবার প্রকাশ করিয়াছে, তাহা অন্তত দুইটি কারণে অর্থপূর্ণ। প্রথমত, ইস্তাহার বস্তুটিই ইদানীং ভারতীয় রাজনীতিতে কার্যত অপাঙ্‌ক্তেয়। দলগুলি তাহা প্রকাশ করে, কিন্তু নিজেরাই তাহাকে গুরুত্ব দেয় না, পুস্তিকার পাতা উল্টাইলেই তাচ্ছিল্য স্পষ্ট হয়। নরেন্দ্র মোদীর দল এই বিষয়ে অগ্রগণ্য বলিলে ভুল হইবে না। এই প্রেক্ষাপটে কংগ্রেসের অর্ধশতাধিক পৃষ্ঠার সুবিন্যস্ত ইস্তাহারটিকে পুরানো সু-অভ্যাসে ফিরিবার প্রয়াস হিসাবে দেখিলে ভুল হইবে না। ‘শৈলীই বিষয়বস্তু’— এমন বৈপ্লবিক তত্ত্ব মানিবার প্রয়োজন নাই, কিন্তু শৈলীর পিছনে যদি ভাবনাচিন্তার ছাপ থাকে, তাহার মূল্য অনস্বীকার্য।

Advertisement

দ্বিতীয়ত, প্রচারপত্র হিসাবে দেখিলেও এই ইস্তাহারকে গুরুত্ব দিতে হয়, কারণ তাহা স্পষ্ট ভাষায় ভারতীয় রাজনীতি এবং রাষ্ট্রনীতিকে একটি সুস্থ পরিবেশ ও উদার অগ্রগতির পথে ফিরাইবার কথা বলিয়াছে। গত পাঁচ বছরে সামাজিক স্বার্থের প্রতিকূল যে দায়িত্বজ্ঞানহীন ভ্রান্ত আর্থিক নীতি ভারতীয় অর্থনীতির স্বাস্থ্য ও জনকল্যাণী সম্ভাবনাকে ধ্বংস করিয়া চলিয়াছে এবং যে অসহিষ্ণু অতিজাতীয়তাবাদ ভারতীয় গণতন্ত্রের মূল কাঠামোটিকেই বিপন্ন করিতেছে, তাহার প্রতিষেধক হিসাবে উদার সুস্থতায় ফিরিবার এই অঙ্গীকার কেবল স্বাগত নহে, অত্যাবশ্যক। ইহার দুইটি প্রধান অঙ্গ। এক দিকে ‘ইনক্লুসিভ গ্রোথ’ বা সর্বজনীন উন্নয়নের বিবিধ প্রকরণ— যেমন দরিদ্রতম ২০ শতাংশের ন্যূনতম আয়ের জন্য বিশেষ আর্থিক সাহায্য, কাজ চাহিলেই কাজ দিবার বর্ধিত নিশ্চয়তা, শিক্ষায় ও স্বাস্থ্যে সরকারি বরাদ্দ বাড়াইয়া রাষ্ট্রকে চালকের আসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠা, দ্বাদশ শ্রেণি অবধি শিক্ষার অধিকার, সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবার অধিকার। অন্য দিকে গণতান্ত্রিকতার শর্তকে মান্য করিয়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের তথা শাসক গোষ্ঠীর দমনপীড়নের হাতিয়ারগুলিকে প্রতিহত বা নিয়ন্ত্রিত করিবার বিবিধ প্রকরণ— যেমন কাশ্মীর নীতিতে কঠোরতা ও উদারতার সমন্বয় সাধন, সেনাবাহিনীর হাতে যথেচ্ছাচারের ক্ষমতা প্রদায়ী আফস্পা নামক আইনটির প্রয়োগ সম্বন্ধে পুনর্বিবেচনা, মানহানিকে ফৌজদারি অপরাধের পরিসর হইতে নিষ্কৃতি দেওয়া, রাষ্ট্রদ্রোহ আইন বাতিল করা, বিদ্বেষী হিংসার প্রতিরোধে স্বতন্ত্র আইন।

যে কোনও অঙ্গীকারপত্র সম্পর্কে অনিবার্য প্রশ্ন: সুযোগ পাইলে দলনেতারা প্রতিশ্রুতি পূরণে কতটা উদ্যোগী হইবেন? অতীতে, এবং সাম্প্রতিক অতীতেও, দীর্ঘ দেশশাসনের সুযোগ পাইয়া কংগ্রেস ও তাহার শরিকরা সুযোগের অপচয় করিয়াছে বিস্তর। সেই অপচয়ের কিছুটা অপদার্থতার কারণে, অনেকটাই অনিচ্ছা, অনাগ্রহ বা দুর্নীতির প্রভাবে। সুতরাং অভিজ্ঞ নাগরিক অবশ্যই বলিবেন, না আঁচাইলে বিশ্বাস নাই। রাষ্ট্রদ্রোহ আইন বা মানহানির মতো বিষয়গুলিতে কংগ্রেসের ঐতিহাসিক ভূমিকা কলঙ্কজনক, তাহাও অনস্বীকার্য। ক্ষমতায় ফিরিতে পারিলে বহু ক্ষেত্রেই তাহার আত্মশুদ্ধি এবং প্রায়শ্চিত্তের প্রয়োজন। কিন্তু ইস্তাহারের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় বিজেপি নেতাদের যে মন্তব্য প্রচারিত হইয়াছে, তাহাই বলিয়া দেয়, কেন এই মুহূর্তে সুস্থতায় ফিরিবার প্রয়োজন সর্বাধিক। অরুণ জেটলিদের বক্তব্যের সারকথা একটিই: উদার সহিষ্ণু গণতন্ত্রের কথা বলা মানেই দেশকে ‘টুকরো’ করিবার চক্রান্ত। বাঙালি কবি বলিতেন: এ বড় সুখের সময় নয়।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন