পরিকাঠামোর উন্নয়ন না হলে পড়ুয়াদের সার্বিক উন্নয়ন দুষ্কর

গ্রামের অনেক স্কুলেই হয়তো দেখা যাবে এক জন মাত্র শিক্ষক বা শিক্ষিকাই পড়াচ্ছেন। তিনিই প্রশ্নপত্র তৈরি করছেন, খাতা দেখছেন; তিনিই হিসাবরক্ষক, করণিক এবং কোনও ক্ষেত্রে মিড-ডে মিলের রাঁধুনিও। এই ভাবে তাঁর শিক্ষক সত্ত্বা ক্লান্ত হয়ে যাবে না তো! প্রশ্ন তুললেন দেবাশিস সরখেল দশ ফুট বাই বারো ফুটের ঘরে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে রয়েছে জনা চল্লিশ পড়ুয়া।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:১৫
Share:

পরিকাঠামোর অভাবে বাধা পাচ্ছে শিক্ষাদানের কাজ। নিজস্ব চিত্র

দশ ফুট বাই বারো ফুটের একটা ঘর। সেটাই ক্লাসরুম। সেটাই স্কুল।

Advertisement

সেই ঘরে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে রয়েছে জনা চল্লিশ পড়ুয়া। তাদের সামনে বই খোলা। পড়াচ্ছেন এক জন শিক্ষক বা শিক্ষিকা। স্কুলের একমাত্র শিক্ষক বা শিক্ষিকা তিনিই। সেই ক্লাসরুমের মাথার চাল গত বছর ভেঙে গিয়েছে হয়তো। সর্বত্র ছবিটা এক না হলেও এটি হয়তো একটি সরকারি প্রাথমিক স্কুলের নমুনা-চিত্র।

সেই স্কুলের উঠোনের সীমান্তে হয়তো একটা টিউবওয়েল রয়েছে। অথবা নেই। একটা শৌচালয় রয়েছে হয়তো কিংবা নেই। অলেক ক্ষেত্রে হয়তো স্কুলবাড়ি নেই। বাড়ি থাকলেও পৃথক ক্লাসঘর নেই। শিক্ষক, নেই শিক্ষাকর্মী, নেই বেঞ্চ। আসলে এত কিছু ‘নেই’-এর মাঝে দাঁড়িয়ে আগামী প্রজন্মকে জীবনের জন্য প্রস্তুত করার কাজটা সহজ নয়। কিন্তু মনে রাখা দরকার যথাযথ উপকরণ না থাকলে কোনও কাজই পূর্ণতা পায় না। শিক্ষাক্ষেত্রেও এই উপকরণগুলির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

Advertisement

এখনও দেখা যায়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলির অনেক ক্ষেত্রেই নিজস্ব ভবন নেই। দুর্গামন্দির, স্থানীয় ক্লাব ইত্যাদি জায়গায় স্কুল চলছে। দেখেছি, এক সময় রঘুনাথপুরের একটি দুর্গামন্দিরে প্রাথমিক স্কুল চলত। সেখানে দেখা যেত এক শিক্ষিকা নিয়ম করে আসছেন। বসে থাকছেন। ‘ডিউটি’ করছেন। অথচ এক জন ছাত্রছাত্রী সেখানে পড়তে আসছে না। এমন অনেক প্রাথমিক স্কুল চোখে পড়বে, যেখানে হয়তো ক্লাসঘর রয়েছে। কিন্তু ক্লাসঘরের সংখ্যা একটি। সেই একটি ক্লাসঘরেই গাদাগাদি করে প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়ারা বসছে। পড়াশোনা করছে।

গ্রামের দিকে অনেক স্কুলেই হয়তো দেখা যাবে একজন মাত্র শিক্ষক বা শিক্ষিকাই প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের পড়াচ্ছেন। তিনিই প্রশ্নপত্র তৈরি করছেন, তিনিই খাতা দেখছেন, তিনিই সেই স্কুলের হিসাবরক্ষক, তিনিই করণিক এবং কোনও ক্ষেত্রে তিনিই মিড-ডে মিলের রাঁধুনি। এই সমস্ত ভূমিকা একহাতে পালন করতে করতে কোথাও তাঁর শিক্ষক সত্ত্বা ক্লান্ত হয়ে যায় না তো! যে স্কুলে স্বনির্ভর দলের সদস্যেরা ‘মিড ডে মিলে’র কাজটা সামলে দেন, সেখানেও ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর পাশাপাশি, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আনুষঙ্গিক অনেক কাজই সামাল দিতে হয়।

অনেক প্রাথমিক স্কুলেই এখন পানীয় জলের সমস্যার সমাধান হয়েছে। তবে স্কুল প্রতি পরিচ্ছন্ন শৌচালয় এখনও সুলভ নয়। শৌচকর্ম সারতে অনেক ক্ষেত্রেই বাচ্চারা মাঠে-ঘাটে যাচ্ছে। সমস্যায় পড়তে হচ্ছে সেই স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও। বিশেষ করে শিক্ষিকাদের ক্ষেত্রে সমস্যাটা গুরুতর।

বেসরকারি প্রাথমিক ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মূল পার্থক্যের মধ্যে একটি হল—সরকার পোষিত স্কুলে শিক্ষাকর্মী নিয়োগের বন্দোবস্ত নেই। ফলে, পড়ুয়াদের সমস্ত বিষয় সামলানো কিন্তু মুখের কথা নয়। বেলা গড়াতে না গড়াতেই অধিকাংশ পড়ুয়ার নজর গিয়ে পড়ে ধূমায়িত উনুনের দিকে। কারণ, তাদের খিদে পেয়েছে। আর স্কুলে মধ্যাহ্নের খাবার দেওয়া বাধ্যতামূলক। খাওয়াদাওয়ার পর্ব চুকে গেলে পড়ুয়াদের ক্লাসঘরে আগলে রাখা মুশকিল হয়ে যায় একা শিক্ষক বা শিক্ষিকার পক্ষে। বিদ্যালয়ের পরিচ্ছন্নতা, শিশুদের শৌচালয়ের পরিচ্ছন্নতা রক্ষায় শিক্ষকদেরই প্রধান ভূমিকা নিতে হয়।

তবে এ কথাও ঠিক, পরিকাঠামোর আমূল পরিবর্তন না হলেও সরকার পোষিত প্রাথমিক স্কুলগুলির গুণগত মানের পরিবর্তন ঘটেছে। সর্বশিক্ষা মিশন ও অভিযানের আনুকূল্যে শৌচাগার ইত্যাদি নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। এখন সেগুলির যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন। বই, খাতা, ব্যাগ, জুতো ইত্যাদির সরবরাহ প্রায় নিয়মিত। মিড-ডে মিলের খাবারও মিলছে। তবে খেয়াল রাখতে হবে পড়ুয়ার মানোন্নয়নের কোনও যথার্থ নথিপত্র জমা দেওয়ার কড়াকড়ি নেই। শিক্ষার অধিকার আইনে স্কুল সকলকে ভর্তি নিতে বাধ্য। একটি স্কুলে আবেদনকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুব বেশি হয়ে গেলে প্রয়োজনে লটারি করা যেতে পারে, কিন্তু শিক্ষার্থীর মান যাচাই করা হচ্ছে না।

প্রাথমিক স্কুলগুলিতে ‘সার্কল’ ধরে ধরে নানা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় মাঝেমধ্যে। তা করার কারণ, সরকারি খাতায়কলমে সার্বিক মানোন্নয়নের কথা বলা রয়েছে। ছাত্রছাত্রীর বৌদ্ধিক, মানসিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক বিকাশ সাধনও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অন্যতম লক্ষ্য। লোকবল না থাকায় শিক্ষক-শিক্ষিকারাই সে সব প্রতিযোগিতায় পড়ুয়াদের নিয়ে হাজির হন।

এক সময় স্কুলের মান পরীক্ষায় পরিদর্শন একটি প্রধান বিষয় ছিল। বর্তমানে তা হয় না বললেই চলে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা দফতরকে দোষারোপ করে লাভ নেই। কারণ, পরিদর্শকদের কাজের পরিসর এখন বহু বিস্তৃত। তবু সাধারণ-অসাধারণ পরিকাঠামোগত সমস্যাগুলির কথা কোথাও তো পৌঁছনোর প্রয়োজন হয়।

এর অর্থ এটা নয় যে, পরিকাঠামো থাকলেও সব সরকারি প্রাথমিক স্কুলে সব শিক্ষক-শিক্ষিকা নিজেদের সব ভূমিকা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছেন। তবে পরিকাঠামোর সুবিধাটুকু যোগ হলে, তাঁদের অনেকের পক্ষে ‘নেই তাই হয় না’ গোত্রের যুক্তি দেওয়া সম্ভব হবে না।

সব মিলিয়ে শিক্ষা বাজেটে অর্থ বরাদ্দ বাড়়ানো, উপযুক্ত সংখ্যক শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ, সর্বোপরি সর্বাঙ্গীন বিকাশের ক্ষেত্র প্রস্তুতে অধিকতর প্রয়াস, যা জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের আশু কর্তব্য সে দিকে অবশ্যই নজর দেওয়া উচিত। স্কুলবাড়ি, ক্লাসরুম, শৌচালয়ের পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং সর্বোপরি উপযুক্ত সংখ্যক শিক্ষক-শিক্ষিকার শূন্য পদ পূরণ না করলে পড়ুয়াদের সার্বিক উন্নয়ন ঘটানো মুশকিল।

লেখক রঘুনাথপুরের জিডি ল্যাং ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন