হিন্দুরা বহু দিন ধরে এই অভিযোগ করে আসেন যে, হজ যাত্রীদের বিভিন্ন সময়ে অনুদান দেওয়া হয়ে থাকে তা হলে কেন হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অনুদান দেওয়া হয় না?
কিন্তু তাঁরা এটা কখনওই বলেন না যে কত টাকা অমরনাথ যাত্রা, কুম্ভ মেলা বা গঙ্গাসাগর মেলাতে সরকারি ভাবে খরচ করা হয়? অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, রাস্তা আটকে নামাজ পড়ার বিষয়ে। কিন্তু তাঁরা কখনওই এটা ভেবে দেখেন না যে বাঙালিদের দুর্গাপুজোয় যে ১০ দিন রাস্তা আটকে রাখা হয়, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুললে তাঁরাই অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন। হঠাৎ করে পাড়ায় পাড়ায় শিবরাত্রির পুজোর সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে। দু-তিন বছর আগেও বাংলায় রামনবমীর মিছিল নিয়ে এত উন্মাদনা ছিল কি? রামনবমী এই মুহূর্তে একটি রাজনৈতিক দলের আগ্রাসন দেখানোর পদ্ধতি ছাড়া কিছু নয়। যার ফলশ্রুতিতে ইমাম রশিদির ছেলের মৃত্যু ঘটলেও সেটা বাঙালি হিন্দুদের গায়ে লাগে না।
তা হলে কি এতটাই অসংবেদনশীল হয়ে উঠেছে বাঙালি হিন্দু মনন? তাঁরা তাঁদের দীর্ঘ দিনের প্রতিবেশী সম্পর্কে এতটা ঘৃণা পোষণ করতেন? যা এত দিন শুধু ঢাকা ছিল? তা হলে কি প্রত্যেকটি হিন্দু মনে গডসে বা প্রজ্ঞা ঠাকুরেরাই থাকবেন? বা বলা ভাল, প্রতিটি হিন্দু মনে কি এখন শুধু যোগী আদিত্যনাথের বসবাস? যাঁরা শুধু হিংসা ছড়াবেন আর হিন্দু মননটাকে তাঁরাই নিয়ন্ত্রণ করবেন? যে মননকে তাঁরা যেমন করে বলাবেন, তেমন করেই বলবেন। যে মনন কবর থেকে তুলে মুসলিম মহিলাকে ধর্ষণের কথা বলে যে মনন আখলাক, জুনেইদ, পেহেলু খানদের শুধুমাত্র সন্দেহের বশে মেরে ফেলার দিকে নিয়ে যায়? চারপাশের চেনা মানুষগুলো কি তবে এতটাই অপরিচিত ছিল আমাদের কাছে, না কি আমরা চেনার চেষ্টাই করিনি সেটা ভেবে দেখার সময় কি হয়নি? না কি হিন্দু মধ্যবিত্তের স্বেচ্ছাবৃত্ত অজ্ঞতা, হিন্দু বাঙালি মধ্যবিত্তের তাঁর প্রতিবেশীকে না চেনার এই উন্নাসিকতা তাঁকে তাঁর দীর্ঘ দিনের প্রতিবেশীর থেকে আরও দূরে ঠেলে দেবে?
যদি খেয়াল করা যায়, নতুন যে সংসদ বসবে সেই সংসদে কিন্তু মুসলিম প্রতিনিধি অত্যন্ত নগণ্য। তা হলে মুসলিমদের বা সংখ্যালঘুদের অসুবিধা-সুবিধার কথা কে তুলে ধরবেন? যদি সংসদে তুলেই না ধরা হয়, যদি খবরের কাগজে না আসে আখলাক, জুনেইদ বা পেহেলু খানদের কথা তা হলে তো সংখ্যালঘু যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থাকবে। হাজার ইমাম ভাতা দিলেও যে সংখ্যালঘু মানুষটির সমাজে ঠিক মর্যাদা দেওয়া যায় না, তা রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা কবে বুঝবেন? যে ভয়টা নিয়ে সমাজে সাবির, রিয়াজ বা শামিমেরা বাস করেছেন গত ৫ বছর ধরে, সেই ভয়টা কি কমবে? না কি সংখ্যাগুরুর আধিপত্য তাঁকে আরও চেপে দেবে এই প্রশ্নগুলো সামনে আসছে এ বার।
মানেকা গাঁধী নির্বাচনী প্রচারের সময় বলেছিলেন যে মুসলিমেরা যদি তাঁকে ভোট না দেন তা হলে যেন উন্নয়নটাও আশা না করেন। সেই তিনি কিংবা সাধ্বী প্রজ্ঞার মতো ‘সন্ত্রাসবাদী’রা যখন সংসদে বসবেন তখন কি করণীয়? তখন কি এটা মনে করা খুব বাতুলতা হবে যে, সংখ্যাগুরু মানুষ চাইছেন যে, তাঁদের সহ-নাগরিক সংখ্যলঘুরা মাথা নিচু করে থাকুক?
নির্বাচনে যেহেতু বিজেপি এবং হিন্দুত্ববাদী শক্তিরা ক্ষমতায় ফিরেছে এই হিন্দু-মুসলিম চেনার কাজটা আরও দীর্ঘস্থায়ী হবে। যদি এই শক্তি না-ও ফিরে আসত, তা হলেও সংস্কারের কাজটা কিন্তু করে যেতেই হত। যে কাজের মধ্যে দিয়ে হিন্দু-মুসলিমের দূরত্বটা কমানো সম্ভব। শুধু শ্রেণির লড়াই দিয়ে যা জয় করা হয়তো সম্ভব হবে না। এই গত ৫ বছরের পরে তা হয়তো আরও কঠিন হয়ে গিয়েছে কিন্তু অসম্ভব এখনও হয়নি। এখনও হয়তো আশা আছে। রাজনৈতিক মিটিং-মিছিল করে বা উগ্র হিন্দুত্ববাদকে রুখতে নরম হিন্দুত্ববাদ বা এক ধর্মের মানুষদের তুষ্ট করতে গিয়ে অন্য ধর্মের মানুষদের দূরে ঠেললে কিন্তু এই সমস্যা আরও বাড়বে বই কমবে না। সরকার বা রাষ্ট্রকে উভয় ধর্মের মানুষদের থেকেই সমদূরত্ব বজায় রাখতে হবে এবং পাশাপাশি নাগরিক সমাজ যাতে এই মেলবন্ধনের কাজটা করতে পারে তার দিকে নজর রাখতে হবে। আর নাগরিকদের দায়িত্ব হবে ছোট ছোট পরিসরে বাড়ির বসার ঘরে এই ধরনের আলোচনাকে নিয়ে যাওয়া, যার মধ্যে দিয়েই একমাত্র এই ঘৃণা, বিদ্বেষ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আগুনটা লেগে গিয়েছে এবং সেটা তুষের মতো ধিকিধিকি জ্বলছে। নিভানোর দায়িত্ব আমাদেরই।
লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুকার