মহামতি পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ, তিনি কবিকে নির্বাসন দেওয়ার হুকুম জারি করেন নাই। করিলে আশ্চর্য হইবার কিছু ছিল না, তাঁহার দাপট বিপুল, দাপট দেখাইবার ব্যগ্রতা বিপুলতর। শিক্ষামন্ত্রীর আসন গ্রহণ করা ইস্তক তিনি সুযোগ পাইলেই এক বার করিয়া শুনাইয়া দেন— সরকার কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন দেয়, সুতরাং সরকারের, অর্থাৎ তাঁহার ফরমান মানিয়াই তাঁহাদের চলিতে হইবে। তিনি বলিতেই পারিতেন— কবি শঙ্খ ঘোষ তফাত যান। হয়তো বলিতে সাধ হইয়াছিল, কিন্তু তাঁহার ঘটেও বোধ করি এক আনা কাণ্ডজ্ঞান আছে, অতএব জিহ্বায় রাশ টানিয়াছেন। সম্পূর্ণ টানিতে পারেন নাই, টানিবেনই বা করিয়া, মন্ত্রী বলিয়া কথা! পার্থবাবু জানাইয়াছেন: শঙ্খ ঘোষ সাহিত্য বিষয়ে কথা বলিলে তিনি সেই কথা লইয়া ভাবিতেন, এ বিষয়ে তাঁহার মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় কিছু বলিবেন না।
কোন বিষয়ে? কী মন্তব্য? প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিশতবর্ষ পূর্তির সমাপ্তি অনুষ্ঠানে শঙ্খবাবু ক্ষমতার অপব্যবহার সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়াছেন। ক্ষমতা থাকিলেই যে ক্ষমতা জাহির করিতে নাই, দায়িত্ববোধের সহিত তাহার সদ্ব্যবহার করিতে হয়, এই কালজয়ী সত্য আরও এক বার জানাইয়া দিয়াছেন তিনি। কাহার প্রতি এই সতর্কবাণী, তাহা তিনি বলেন নাই, বলিবার কথাও নহে। তিনি রাজনীতির কারবারি নহেন, তরজা বাধাইবার রাজনৈতিক কুনাট্যে তাঁহার রুচি থাকিবে কেন, তিনি নীতি এবং আদর্শের সন্ধান দিয়াছেন। শিক্ষামন্ত্রী শ্রদ্ধা সহকারে প্রবীণ সাহিত্যিক ও সমাজকর্মীর সেই পরামর্শ অবধান করিতে পারিতেন, ক্ষমতার অধিকারী হিসাবে আপন দায়িত্ববোধের হিসাব কষিতে পারিতেন, নিজের কাছে আত্মশুদ্ধির অঙ্গীকার করিতে পারিতেন। করিলে, রাজ্যের উপকার হইত, তাঁহারও।
কিন্তু মন্ত্রীর নাম পার্থ চট্টোপাধ্যায়। অতএব তিনি ফোঁস করিয়া উঠিয়াছেন। বুঝাইয়া দিয়াছেন, সমালোচনা শুনিবার অভিরুচি তাঁহার নাই, তাহা অতি-বিশিষ্ট চিন্তানায়কের শুভবুদ্ধি হইতে উৎসারিত হইলেও। শঙ্খবাবুর মন্তব্য সম্পর্কে তাঁহার প্রতিক্রিয়ার অর্থটি অনুমান করা সহজ— শিক্ষামন্ত্রী বলিতে চাহিয়াছেন, সাহিত্যিক সাহিত্য আলোচনায় সীমিত থাকুন, তাঁহার সমালোচনা বা পরামর্শ শুনিবার দায় শাসকের নাই। এই মানসিকতার স্থান গণতন্ত্রের বিপরীত মেরুতে। গণতন্ত্রে সমালোচনাকে শ্রদ্ধা করাই শাসকের দায়িত্ব, বিশেষত সেই সমালোচনা যদি দলীয় রাজনীতির বাহির হইতে আসে। বস্তুত, এই দায়িত্ব শাসকের আপন মঙ্গলের স্বার্থেই পালনীয়। স্তাবকদের দ্বারা পরিবৃত থাকিলে শেষ অবধি শাসকের পরিণতি যে শুভ হয় না, ইতিহাস তাহা বারংবার প্রমাণ করিয়াছে। পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসও তাহার ব্যতিক্রম নহে। কিন্তু বর্তমান শাসকরাও সেই ইতিহাসের শিক্ষা লইতে অপারগ, অথবা নারাজ। তাঁহারা ভাবেন, সমালোচক মানেই শত্রু, তাই ভিন্নস্বর শুনিলেই শাসাইতে হইবে, নিদেনপক্ষে ফোঁস করিতে হইবে। এই মানসিকতার তাড়নাতেই শিক্ষামন্ত্রী প্রেসিডেন্সি বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সম্পর্কে কটু মন্তব্য করেন। এমন মন্তব্য যে তাঁহাকে মানায় না, সে কথা না-হয় ছাড়িয়াই দেওয়া গেল, এই জমানায় সৌজন্যের প্রত্যাশা হয়তো বাতুলতা। কিন্তু গভীরতর প্রশ্ন ইহাই যে, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদ করেন বলিয়াই কি তাঁহারা শিক্ষামন্ত্রীর চক্ষুশূল হইয়াছেন? তাঁহাদের বিক্ষোভের ভঙ্গি ও প্রকরণ লইয়া আপত্তি থাকিতেই পারে, কিন্তু প্রতিবাদে আপত্তি কেন? উত্তর একটিই: ক্ষমতার দম্ভ। সেই দম্ভ যাহাকে গ্রাস করে, যে কোনও বিরুদ্ধ স্বর তাহার ক্রোধ উৎপাদন করে। এই ব্যাধি গণতন্ত্রের পরম শত্রু। শঙ্খ ঘোষ এই ব্যাধি সম্পর্কেই সতর্ক করিয়া দিয়াছেন। অরণ্যে রোদন, তবু এই সতর্কীকরণ জরুরি ছিল।