তাঁর সিনেমায় ভারত আর দুনিয়া জুড়ে ছিল এক সূত্রে

সব অর্থে ‘নাগরিক’ ছিলেন

বাংলা সিনেমায় যেমন মৃণাল সেনের ছবিগুলোর বিপুল প্রভাব পড়েছে, তেমনই ভারতীয় আর্ট ফিল্মেও তাঁর প্রভাব অনস্বীকার্য। ১৯৬০ এবং ১৯৭০-এর দশকে ভারতীয় সিনেমায় ‘নিউ ওয়েভ’ আসে।

Advertisement

রোচনা মজুমদার

শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:২৪
Share:

দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় আর নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর প্রয়াণের পর কয়েক দিনও কাটল না, চলে গেলেন মৃণাল সেনও (১৯২৩-২০১৮)। ৩০ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বঙ্গসংস্কৃতির এক স্বর্ণযুগও ফুরোলো। মৃণালবাবু সিনেমা পরিচালনা করতে আরম্ভ করেন ১৯৫০-এর দশকে— অন্য দুই মহীরুহ সত্যজিৎ রায় আর ঋত্বিক ঘটকের সমসাময়িক তিনি। ১৯৬৯ সালে ‘ভুবন সোম’ তৈরি করেছিলেন হিন্দিতে। ‘নিউ ইন্ডিয়ান সিনেমা’-র সূচনালগ্ন হিসেবে এই ছবিটিই স্বীকৃত। অবশ্য তার ঢের আগেই বাঙালি দর্শক মজেছিল মৃণাল সেনের সিনেমায়। তর্ক করেছিল সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণালের ছবি নিয়ে। মৃণাল সেনের বাইশে শ্রাবণ, আকাশকুসুম বা ইন্টারভিউ নিয়ে কী বিপুল আলোচনা হয়েছিল, পুরনো ফিল্ম ম্যাগাজ়িনের পাতা উল্টোলে তার প্রমাণ মিলবে।

Advertisement

বাংলা সিনেমায় যেমন মৃণাল সেনের ছবিগুলোর বিপুল প্রভাব পড়েছে, তেমনই ভারতীয় আর্ট ফিল্মেও তাঁর প্রভাব অনস্বীকার্য। ১৯৬০ এবং ১৯৭০-এর দশকে ভারতীয় সিনেমায় ‘নিউ ওয়েভ’ আসে। আদ্যন্ত নতুন ধাঁচের সব ছবি তৈরি করতে থাকেন এক ঝাঁক পরিচালক, যাঁরা নিজেদের মনে করতেন সত্যজিৎ রায়-উত্তর প্রজন্ম, এবং ভারতীয় সিনেমাকে একটা নতুন দিগন্তে নিয়ে যেতে চাইতেন। সেই দলে ছিলেন আদুর গোপালকৃষ্ণন, শ্যাম বেনেগাল, কুমার সাহানি, মণি কাউলের মতো পরিচালকরা। তাঁদের ছবিগুলো দেখলে বোঝা যায়, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও এই ধারার ভারতীয় সিনেমা কী ভাবে প্রকৃত অর্থেই আন্তর্জাতিক হয়ে উঠেছিল। মৃণাল সেন ছিলেন এই ধারার সিনেমার জন্মদাতা— নতুন থিম, নতুন টেকনিক এবং নতুন রাজনীতির খোঁজ তাঁর ছবিগুলোর অভিজ্ঞান।

নিউ ওয়েভের অন্যান্য পরিচালকদের তুলনায় মৃণাল বয়সে খানিক বড় ছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর ছবির মধ্যে যে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা ছিল, পুরনো ধ্যানধারণাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া ছিল, আর ছিল যে খামখেয়ালি আকস্মিকতা, সেগুলো তাঁকে আলাদা করেছিল সত্যজিৎ রায়ের নেহরু-যুগের ইতিবাচকতা বা ঋত্বিক ঘটকের দেশভাগ-উত্তর যন্ত্রণাবোধ থেকে। বলা যায়, এই তিন জনের মধ্যে মৃণাল সেনই সবচেয়ে বেশি ‘নাগরিক’ ছিলেন।

Advertisement

বাংলা আর হিন্দি বাদে মৃণাল সেন ওড়িয়া আর তেলুগুতে একটা করে ছবি বানিয়েছিলেন। বনফুল, সমরেশ বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র বা রমাপদ চৌধুরীর গল্প নিয়ে ছবি করেছেন তিনি, কিন্তু শুধু বাঙালি লেখকের রচনাতেই থেমে থাকেননি। ১৯৫৮ সালের ছবি ‘নীল আকাশের নীচে’ তৈরি করেছিলেন মহাদেবী বর্মার লেখার ওপর ভিত্তি করে। ‘মাটির মনিষ’ (ওড়িয়া, ১৯৬৬) আর ‘মৃগয়া’-র জন্য ওড়িয়া লেখক কালিন্দীচরণ পানিগ্রাহী আর ভগবতীচরণ পানিগ্রাহীর গল্প ব্যবহার করেছিলেন। ‘ওকা উরি কথা’ (তেলুগু, ১৯৭৭) তৈরি করেছিলেন মুন্সি প্রেমচন্দের হিন্দি গল্পের ভিত্তিতে, আর ‘অন্তরীণ’ (১৯৯৩)-এর পিছনে ছিল সাদাত হাসান মান্টোর ছোটগল্প। আরও উল্লেখযোগ্য, তাঁর ছবির লোকেশন হিসেবে মৃণাল সেন বেছে নিয়েছিলেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে। গুজরাত, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গের নানান ছোট শহর। আর, কলকাতা তো বটেই।

তাঁর দীর্ঘ ফিল্মজীবনে মৃণাল সেন বানিয়েছেন মোট ২৭টি পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি, ১৪টি শর্ট ফিল্ম, পাঁচটি তথ্যচিত্র। পেয়েছেন প্রচুর পুরস্কার, সম্মান— দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পেয়েছেন, রাজ্যসভায় সাম্মানিক সাংসদ মনোনীত হয়েছেন (১৯৯৮-২০০৩), ফরাসি সরকার দিয়েছে কম্যান্দর দ্য লর্দর দেজ়ার্ত এ লেত্র (Commandeur de l'ordre des Arts et letters), রুশ সরকার দিয়েছে ‘অর্ডার অব ফ্রেন্ডশিপ’। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব দ্য ফিল্ম সোসাইটিজ়-এর সভাপতি ছিলেন মৃণাল। কান, ভেনিস, বার্লিন, মস্কো, কার্লভি ভারি, টোকিয়ো, তেহরান, মানহেইম, নিয়ন, শিকাগো, গেন্ট, টিউনিস ও ওবরহাউসেন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আন্তর্জাতিক জুরির সদস্য ছিলেন।

ফিল্ম সোসাইটি-র সক্রিয় কর্মীও ছিলেন মৃণাল সেন। ১৯৬৮ সালে ফিল্ম সোসাইটির সহকর্মী অরুণ কাউলের সঙ্গে তিনি তৈরি করেন ভারতীয় ‘নিউ সিনেমা মুভমেন্ট’-এর ইস্তেহার। সেই ইস্তেহারে তাঁরা ভারতীয় সিনেমায় নতুন প্রযোজনা, প্রদর্শন ও ডিস্ট্রিবিউশনের প্রয়োজনের কথা লেেখন। বলেন, ‘নিউ সিনেমা’-কে চিন্তা-আধিপত্যের প্রতিস্পর্ধী অবস্থানের কথা বলতেই হবে। তার জন্য নতুন পদ্ধতি প্রয়োজন, পরীক্ষানিরীক্ষা প্রয়োজন। বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ার ঝুঁকিও নিতে হবে।

সত্যি কথা বলতে, মূলধারার দর্শকের চোখে মৃণাল সেনের কিছু সিনেমা দুর্বোধ্য ঠেকেছে, শ্লথ মনে হয়েছে। কিন্তু, কিছু ক্ষেত্রে সমসাময়িক ইতিহাসের ওলটপালট দর্শককে টেনে এনেছে ‘কলকাতা ৭১’ (১৯৭২)-এর মতো আভাঁ-গার্দ ছবির দিকেও। ষাট-সত্তরের দশকের উত্তাল নকশাল আন্দোলনের ঘূর্ণিতে পরিবার থেকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া কোনও প্রিয় জনকে এক ঝলক দেখার আশায় কী ভাবে সাধারণ মানুষ ভিড় করেছিলেন মেট্রো সিনেমায়, মৃণাল সেন সেই স্মৃতিচারণ করেছেন। তাঁর কলকাতা ট্রিলজি-তে (ইন্টারভিউ, কলকাতা ৭১ আর পদাতিক) এমন বেশ কিছু ফুটেজ ব্যবহৃত হয়েছে, মৃণাল সেন যা তুলেছিলেন একেবারে জ্বলজ্যান্ত বাস্তবে। তখন কি আর তিনি জানতেন, বহু শোকার্ত পরিবারের কাছে সেই ফুটেজগুলোই প্রিয় জনের শেষ দেখা হয়ে থাকবে— যাঁদের কী পরিণতি হল, জানার আর কোনও উপায় থাকবে না?

মৃণাল সেন বিষয়ে আমার নিজের কয়েকটা পর্যবেক্ষণের কথা বলি। প্রথমত, মৃণাল ছিলেন নিজের তীব্রতম সমালোচক। ‘বাইরের শত্রু’ নয়, তিনি বার বার আক্রমণ করতে চেয়েছেন ‘ভিতরের শত্রু’কে। তিনি বামপন্থী রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু বাম রাজনৈতিক দলগুলির মতান্ধতা এবং পুরুষতন্ত্রের কথা স্বীকার করেছেন প্রকাশ্যে। শ্রেণিগত ভাবে তিনি ছিলেন ‘বাঙালি ভদ্রলোক’— সেই শ্রেণির সুতীব্র সমালোচনা করেছেন তিনি। বাঙালি মধ্যবিত্তের বামপন্থী ভাবনায় নারীবাদী চাবুক চালিয়েছেন ‘পদাতিক’, ‘একদিন প্রতিদিন’-এর মতো ছবি দিয়ে।

দ্বিতীয়ত, তাঁর সিনেমাগুলোকে ক্ষুধার ঐতিহাসিক নথি হিসেবেও দেখা সম্ভব। একের পর এক ছবিতে তিনি ফিরে গিয়েছেন দুর্ভিক্ষের বিভীষিকায়। শুধু ১৯৪৩-এর মন্বন্তর নয়, উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতে যে মর্মান্তিক খাদ্যসঙ্কট তৈরি হয়েছিল ষাট আর সত্তরের দশকে, সেই কথা বারে বারে মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি। ‘বাইশে শ্রাবণ’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘মাটির মনিষ’, ‘আকালের সন্ধানে’ তেমনই কিছু ছবি। তিনি ভাবতেন, ক্ষুধাই পারে মধ্যবিত্তকে তার নিশ্চিন্ত গৃহকোণ থেকে তীব্র রাগের রাজনীতির পথে টেনে আনতে।

তৃতীয়ত, তাঁর শিকড় ছিল বাংলায়, কিন্তু তাঁর সিনেমা ছিল আন্তর্জাতিক রাজনীতির বোধে ঋদ্ধ। তাঁর ছবির সমসময়ে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় যে সব ঘটনা ঘটেছে— যেমন ভিয়েতনাম বা লাতিন আমেরিকায় যুদ্ধ— মৃণাল সেন নিজের ছবিতে সেই সব ঘটনার ডকুমেন্টরি ফুটেজ ব্যবহার করেছেন আশ্চর্য দক্ষতায়। তাঁর ছবিতে ভারত সব সময়ই আন্তর্জাতিক ঘটনাক্রমের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। তাঁর ছবির রাজনৈতিক অবস্থান সুস্পষ্ট, কিন্তু একটা অদ্ভুত সেন্স অব হিউমারও ছিল ছবিগুলিতে, ছিল একটা বিস্ময়বোধ। গুজরাতের প্রান্তরে গ্রাম্ভারি বাঙালি আমলা ভুবন সোম যে সব কার্যকলাপ করছিলেন, সমসাময়িক সমালোচকরা অনেকেই তা নিয়ে কড়া কথা বলেছেন। কিন্তু নায়কের নামে নামাঙ্কিত সিনেমাটিতে আমরা সাম্রাজ্যবাদ-উত্তর ভারতীয় মধ্যবিত্তের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের এক অসামান্য কাহিনি পাই, যে কাহিনি এক সাবঅলটার্ন নারীর সঙ্গে অপ্রত্যাশিত আদানপ্রদানের মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে।

চার্লি চ্যাপলিনকে নিয়ে একটা বই লিখেছিলেন মৃণাল সেন। তাঁর দীর্ঘ চলচ্চিত্রজীবনে মৃণালও খানিকটা চ্যাপলিনের মতোই। বেপরোয়া, কৌতুকময় এবং নিয়ম-ভাঙা এক শিল্পী।

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে সাউথ এশিয়ান ল্যাঙ্গোয়েজেস অ্যান্ড সিভিলাইজ়েশনস, সিনেমা অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ়-এর শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন