—ফাইল চিত্র।
একটি বিষয়ে ভাবনাচিন্তার প্রয়োজন। আগের আলোচনার (‘খোলাখুলি যা বলা দরকার’, ২৭-১১) সূত্র ধরে বলার চেষ্টা করছি। এক বৃহদাকার জনগোষ্ঠী, এ ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠদের কথা ধরুন। নিজেদের ধর্ম সম্পর্কে এক ধরনের ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি এ ধরনের গোষ্ঠীর মধ্যে এক অদৃশ্য সূত্রের কাজ করে। অনেক সময় এদের মধ্যে আবার বিভিন্ন উপগোষ্ঠী এক এক ধরনের ঐতিহাসিক ঘটনাকে নিজেদের মতো করে সাজায়। কিন্তু কোথাও কিছু কিছু ঐতিহাসিক সত্যকে আলোচনার পরিসরে একেবারে প্রান্তিক করে রাখলে এক ধরনের বিক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে। ইতিহাসের কোনও কোনও সময় তাঁদের সঙ্গে অন্যায় হয়েছে, এই কথা সর্বসমক্ষে স্বীকার করা অনেক সময় ভবিষ্যতে প্রগতিশীল পদক্ষেপ করতে সাহায্য করে। আমরা হয় হিন্দুধর্মের অত্যাচার আর কুসংস্কারের কথা বলব, নয় সন্ত্রাসবাদ আর পয়সার বিনিময়ে ধর্মান্তরিত করার অভিযোগ শোনাব। কিন্তু হিন্দুধর্মের অন্তর্মুখী দর্শনের সহিষ্ণুতা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, ধর্মান্তরের প্রভাবে অন্য ধরনের শৈল্পিক জীবনযাত্রার প্রবাহ, এ সব নিয়ে তেমন কোনও কথা বলব না। হিন্দুধর্মকে কোনও ভাবে প্রশংসা করাটা সাম্প্রদায়িকতার চর্চা করা— এই ভ্রান্ত ধারণা থেকেই অনেক সমস্যার উৎপত্তি। অন্য দিকে শুচিবাইগ্রস্ত হিন্দু সভ্যতার চেয়ে খ্রিস্টান মিশনারিদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতি মনোযোগ সমাজের কত বেশি উপকার করেছে, সেটাও আমরা দেখেছি। ঈশ্বরের প্রার্থনার স্থান কত নোংরা হতে পারে, সে ব্যাপারে আমার ধর্মের ব্যবহারিক রূপ সবার চেয়ে এগিয়ে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, মা সারদা এবং স্বামী বিবেকানন্দ সর্ব ক্ষণ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, পরধর্মে শ্রদ্ধার কথা বলে গেলেন, আর তাঁদের ছবি এ দিক ও দিক টাঙিয়ে হয় অন্য ধর্মের মানুষদের কী করে শাস্তি দেওয়া যায় তারই ছক করছি, নয় তোষণকেই করেছি মহামন্ত্র।
এক জন হিন্দুধর্মালম্বীর ইতিহাসে ঘটে যাওয়া ধর্মের নামে অত্যাচারের ঘটনা ভাল লাগে না। মন্দির ভেঙে মসজিদ তৈরি তাঁর আত্মসম্মানে ধাক্কা মারবে, এটাই স্বাভাবিক। ধর্মের নামে অত্যাচার অন্যায় হয়েছে। এটা সত্যি। এ বিষয়ে স্পষ্ট মতামত না দেওয়া খাঁটি রাজনৈতিক ভণ্ডামি। সেটা শুধু রাজনীতির মানুষেরাই করেন না, অন্যরাও করেন। কিন্তু আমার সঙ্গে মকবুলের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের ঘটনাটাও ততটাই সত্যি। আমাদের একসঙ্গে পরস্পরকে সম্মান করে বেঁচে থাকাটাই আমাদের সামাজিক কর্তব্য, নিজেদের জন্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। আমার হিন্দুত্বের শান্তিপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ আসলে সাম্প্রদায়িকতার প্রতিফলন আর মকবুল আসলে পাকিস্তানপন্থী এবং সন্ত্রাসবাদের সমর্থক— এই দু’টি চরম বিপরীতধর্মী ধারণা তৈরি হয়েছে আমাদের দূরদর্শিতার অভাবে। একে অপরকে শাস্তি দেওয়ার যে খেলা আমরা খেলতে বাধ্য হচ্ছি, সেখানে রাজনীতির সঙ্গে মিশে রয়েছে তথাকথিত উদারনৈতিক ভণ্ডামি যা ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক ইতিহাসকে চিরকাল উপেক্ষা করে চলেছে। হিন্দু-মুসলমানের বন্ধুত্ব, যৌথ শিল্পচর্চার ইতিহাস পড়লে বোঝা যাবে অধ্যাত্মবাদের এক অদ্ভুত অন্তঃসলিল যোগাযোগ। যত দিন না সেটা আরও বেশি সামনে আসছে, তত দিন এই ভয়ঙ্কর খেলাটা থেকে আমাদের কোনও মুক্তি নেই। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট হয়তো হারজিতের খেলাগুলো ঠেকিয়ে রাখবে, কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে আমরা মুক্তি পাব না।
এই দেশটাকে আধ্যাত্মিকতা বাদ দিয়ে বোঝা যাবে না। বিভিন্ন ধরনের আধ্যাত্মিকতার সমাহারই আসলে বিবিধের মাঝে মিলনের উৎস। নাস্তিকতাও অবশ্যই একটি আলাদা ধর্ম। মহামতি আকবর অনেক দিন আগে যা বুঝেছিলেন, আমরা এখনও তা বুঝিনি। দেশটাকে চালাতে ধর্ম বাদ দেবেন না। ধর্মের মেলবন্ধনটাই আসল। ইতিহাসকে ঠিক করে শোধরানোর আর সাম্প্রদায়িকতার ভূতকে তাড়াতে গেলে ধর্মাচরণকে আফিম বলে ভাবলে চলবে না। এটা সে দেশ নয়। নিঃসন্দেহে ধর্ম আমার আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার, কিন্তু কোথাও একটা উৎসব গড়ে তুলতে হবে, যেখানে সবাই শামিল হব। আফিম বা গাঁজাখেকো তথাকথিত প্রগতিশীল নেশাখোরদের মুক্তিকামী অচেতন মনের মিল সেখানে কাম্য নয়, নিজ ধর্মে নিষ্ঠা আর পরধর্মে শ্রদ্ধাই সেখানে কাম্য। সেটা বুঝেই একটা উন্নততর ভবিষ্যৎ আমাদেরই তৈরি করতে হবে। সেখানে সর্বজনগ্রাহ্য এক আধ্যাত্মিকতার খুবই প্রয়োজন। সজ্ঞান সচেতন আধ্যাত্মিকতা।
নতুন করে হতাশার কথা বলার কিছু নেই। ধর্মাধর্মের রাজনীতি নামক বেড়ালটার গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? ভোটের হিসেবই আসল। যেখানে যাঁরা বেশি সেখানে তাঁরাই গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে কুসংস্কার ও কুশিক্ষায় ভরপুর টেলিভিশন সিরিয়ালের এত রমরমা হয় না। বাংলাভাষী মানুষ খানিকটা অতিরিক্ত সুখ-শান্তির মুখ দেখছেন বলে তাঁদের একটি রাজ্য থেকে খেদানোর জন্য প্রায় রাজ্যভিত্তিক নাগরিকত্ব নিয়ে আসছি আমরা। অন্যান্য দুর্নীতিপরায়ণ জনরোষকে হাওয়া দিতে বিরোধী ও শাসক দল উভয়েই আগুয়ান।
সবচেয়ে কষ্ট বেচারা শ্রীরামচন্দ্রের। তাই তাঁকে দিয়েই শেষ করি। কথাগুলো এক কালের সুপরিচিত, রাজ্য নাট্য আকাদেমি পুরস্কৃত এক নাটকের: “অলি গলি কেন হাঁট রাম/ ফুটপাতে দেখ কত ধুমধাম।/ ঘেয়ো কুকুরগুলো করে কানাকানি/ কাকেতে চিলেতে সে কি টানাটানি/ হায় রাম কি তোমার পরিণাম।/কালি দিয়ে চুনকাম”।
সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতির অধ্যাপক