দশ বৎসরে দশ লক্ষ শিশুমৃত্যু এড়াইয়াছে ভারত। সম্প্রতি ব্রিটেনের ল্যানসেট পত্রিকায় প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে প্রকাশ, ২০০৫ সালের শিশুমৃত্যুহারে উন্নতি না হইলে অতগুলি সন্তান হারাইতে হইত। শিশুকন্যাদের মৃত্যুহারও কমিয়াছে। ২০১৫ সালের পরিসংখ্যানে পুত্র ও কন্যাদের মৃত্যুহারে পার্থক্য নাই। পাঁচ বৎসরের কম বয়সি শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়া এবং ডায়ারিয়াতে মৃত্যুর হার দশ বৎসর ধরিয়া ক্রমাগত নিম্নমুখী। কিন্তু নবজাতকের মৃত্যু প্রতিরোধ করিবার কাজে সাফল্য আসে নাই। একবিংশের ভারতের উন্নয়নের চিত্রে স্বল্প ওজনের নবজাতকের মৃত্যু এক প্রধান সংকট। এত অপুষ্ট শিশু কী করিয়া জন্মাইতেছে, সে প্রশ্ন বিস্মিত করিতে বাধ্য। দেশে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হইয়াছে, দারিদ্র কমিয়াছে, নানা সূচকে মেয়েদের উন্নতি হইয়াছে। তাহাদের বিবাহের বয়স বাড়িয়াছে, শিক্ষার হারও পূর্বের তুলনায় উন্নত। তবু প্রতি বৎসর মোট বারো লক্ষ শিশুমৃত্যুর আটান্ন শতাংশই নবজাতকের মৃত্যু।
ইহার একটি পরিচিত ব্যাখ্যা, এক ভারতে অনেক ভারতের বাস। স্বল্প ওজন ও তজ্জনিত মৃত্যুর সত্তর শতাংশই ঘটিতেছে দরিদ্রতর রাজ্যগুলিতে। তামিলনাড়ু, কর্নাটক, মহারাষ্ট্রে নবজাতকের জীবন যত সুরক্ষিত, সেই লক্ষ্যে পৌঁছাইতে গোটা দেশকে অপেক্ষা করিতে হইবে ২০৩০ সাল অবধি। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, মেয়েদের মধ্যে অপুষ্টি অত্যন্ত ব্যাপক, তাহাই স্বল্প ওজনের কারণ। তাহার মোকাবিলা করিতে হইবে। খাদ্য সুরক্ষা আইনে গর্ভবতী মহিলাদের জন্য ছয় হাজার টাকা অনুদানের কথা বলা হইয়াছে, যাহা বহু দিন উপেক্ষিত হইবার পর সম্প্রতি কার্যকর হইয়াছে। গর্ভাবস্থার গোড়াতেই এই টাকা মিলিলে মহিলাদের পুষ্টির প্রয়োজন মিটিতে পারে। বহু উন্নত দেশেও গর্ভবতী ও সদ্যপ্রসূতিদের পুষ্টির জন্য অনুদানের প্রচলন রহিয়াছে। ভারতেও তাহা চালু করিবার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি আছে।
কিন্তু মহিলাদের পুষ্টিবিধানের জন্য যে প্রকল্পগুলি রহিয়াছে, তাহার মূল্যায়নেরও কি প্রয়োজন নাই? দরিদ্র পরিবারে টাকা সংসারের নানা কাজে ব্যয় হইয়া যায়, সেই ঝুঁকির কারণেই অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্পে গর্ভবতী মহিলাদের জন্য রান্না-করা খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা হইয়াছে। চার দশক পার করিবার পরেও যদি তাহা মায়েদের অপুষ্টি-চিত্রে কোনও পরিবর্তন আনিতে না পারে, অপুষ্ট শিশুর মৃত্যু না রুখিতে পারে, তাহা হইলে বৃথা অর্থক্ষয়ের প্রয়োজন কী? এমন প্রশ্ন তুলিলে শোরগোল পড়িয়া যায়— ইহা গরিবকে বঞ্চনা করিবার ষড়যন্ত্র। কিন্তু লক্ষ কোটি টাকা খরচ করিয়া দরিদ্রের কী উপকার হইতেছে, তাহা বুঝিবার উপায় নাই। গর্ভের শুরুতে মহিলাদের ওজন কত, গর্ভাবস্থার শেষে কত, সে তথ্য নাই। কারণ ওজনে পরিবর্তন মাপিয়া নথিভুক্ত করিবার কোনও নির্দেশই নাই। ইহা আশ্চর্য বটে, আবার না-ও বটে। প্রকল্পের কার্যকারিতা বিচার না করিয়া টাকা ঢালিয়া যাওয়া সরকারি কর্তাদের দীর্ঘ দিনের অভ্যাস। তদ্রূপ, রেশন ব্যবস্থার সহিত নারীপুষ্টি, শিশুপুষ্টির সম্পর্ক কী, তাহার উত্তর আজও মেলে নাই। গর্ভবতীর অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাইলে তাহার অনেক উপকার হইবে, সন্দেহ নাই। কিন্তু তাহার ওজন বাড়িবে কি, গর্ভের শিশুর প্রাণের ঝুঁকি কমিবে কি?