নেহরুর প্রশ্ন ছিল, নতুন দেশ গঠনে অযোধ্যার মন্দির কেন দরকার

দুই ভারতের দ্বন্দ্ব, আজও

এই ভারতের নাগরিক আমি। এই রাষ্ট্রের ভোটার। কিন্তু এই ভারতের সাংস্কৃতিক নাগরিকত্ব আছে কি আমার? সাম্প্রদায়িক হিংসা দিয়ে যে ভারতকে টুকরো টুকরো করা হচ্ছে সে ভারতেই থাকতে চাই কি আমি?

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:১৪
Share:

আমি এক জন ভারতীয়। কলকাতায় কফি হাউসের আড্ডায় আমি বাঙালি। লন্ডনের মেট্রোতে সহযাত্রী বৃদ্ধ সাহেব জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনি কি পাকিস্তানি? তখন বলেছিলাম ‘না। আমি ভারতীয়।’ এই যে ভারতীয়-বাঙালি সত্তা, এই দুই পরিচয়েই আমার কোনও হাত নেই। এ তো জন্মসূত্রে।

Advertisement

তবে আজ যে ভারতে বসবাস করছি সেখানে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরে বাবরি মসজিদকে ধূলিসাৎ করে দেওয়া হয়েছে। তার পর ওই বিতর্কিত জমিতেই রাম মন্দির নির্মাণের ঘোষণা হয়েছে। আজ নতুন উদ্যমে সেই নির্মাণের পুনর্ঘোষণা চলছে।

এই ভারতের নাগরিক আমি। এই রাষ্ট্রের ভোটার। কিন্তু এই ভারতের সাংস্কৃতিক নাগরিকত্ব আছে কি আমার? সাম্প্রদায়িক হিংসা দিয়ে যে ভারতকে টুকরো টুকরো করা হচ্ছে সে ভারতেই থাকতে চাই কি আমি? ঈশ্বর যদি আমাকে মালটিপল চয়েস দিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, এ বার কোথায় জন্মাবি? তবে কি বলব, ভারতের বদলে পরের জন্মে লন্ডন, প্যারিসে অথবা নিউ ইয়র্কে জন্মাতে চাই? না। কখনওই তা বলব না।

Advertisement

অটলবিহারী বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন উনি বিদেশে লম্বা সফর করতেন। এক বার আমেরিকায় এক সপ্তাহেরও বেশি থাকার পর ফেরার আগের দিন মিডিয়া সেন্টার থেকে প্রবীণ সাংবাদিক তরুণ বসু বাড়িতে ফোন করে শুদ্ধ বাংলায় স্ত্রীকে বলছিলেন, ‘রাতে বাড়ি ফিরছি। পাতলা মাছের ঝোল আর গরম ভাতের ব্যবস্থা কর। ঢের হয়েছে আমেরিকা। আর পারা যাচ্ছে না।’ মিডিয়া সেন্টারের ভিড়ে তরুণদাকে চিৎকার করে বলেছিলাম, তোমার সঙ্গে আছি, তরুণদা।

এটাই বোধহয় ভারতীয়ত্ব। অতএব এ দেশটাতেই থাকব। মানুষ হিসাবে আমাদের সকলের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে। রুসোর এমিলি চরিত্রে যেমন সত্তার সংঘাত ছিল। এক জন এমিলি সমাজের অসততার সঙ্গে লড়াই করে। অন্য জন তা করে না। মানুষের মতোই রাষ্ট্রের মানস-জগতের মধ্যেও সংঘাত থাকে। তা হলে আমাদের সাবেকি ভারতের ভাবনার সঙ্গে মোদীর ভারত-ভাবনার সংঘাত অস্বাভাবিক হবে কেন?

১৮৫৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জমানাতেও অযোধ্যায় দাঙ্গা হয়েছিল। ব্রিটিশ প্রভু তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটিও গঠন করে তদন্তের জন্য। বহু লোক মারা যায়। সে তদন্ত রিপোর্ট জাতীয় মহাফেজখানায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নথিতে আছে। আবার ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে শীতের রাতেও কিছু ভক্ত তালা ভেঙে বাবরি মসজিদে ঢুকে সরযূ নদীর জল দিয়ে বারান্দা ধুয়ে সেখানে রামলালার মূর্তি স্থাপন করে। অযোধ্যা বিতর্কও তাই এ দেশে নতুন নয়, সাভারকরের দক্ষিণপন্থী হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের কর্মসূচির সঙ্গে ১৯৮৪ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ রাম মন্দির নির্মাণ আন্দোলনকে যুক্ত করে। লালকৃষ্ণ আডবাণী সংঘ পরিবারের এই কর্মসূচিকে বিজেপির আন্দোলনে পরিণত করেন। সেই রাজনৈতিক কর্মসূচি বাবরি মসজিদ ভাঙার ২৫ বছর পর মোদী-অমিত শাহের নেতৃত্বে আরও ভয়ংকর বিভাজনের রণকৌশল।

দেখুন, ব্রিটিশ যুগেই হিন্দু জাতীয়তাবাদের জন্ম। স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর ‘আর্য সমাজ’ বলেছিল, বেদে ফিরতে হবে। সে সময়ে পাঞ্জাবি লালা লাজপত রাই, মরাঠি বালগঙ্গাধর তিলকের মতো নেতারা দয়ানন্দের ভক্ত হন। পাশাপাশি ১৯২৬ সালে কেশব বলিরাম হেডগাওয়ার নাগপুর থেকে হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণা করেন। ৬ ডিসেম্বরের পর থেকে গোধরা কাণ্ড, ওডিশায় খ্রিস্টান ধর্মযাজক পুড়িয়ে মারা, বাইবেল পোড়ানো থেকে আজকের গো-রক্ষকদের তাণ্ডব, এ সবই এক সুতোয় বাধা।

১৯৫০ সালের ১৮ অক্টোবর উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দবল্লভ পন্থ নেহরুকে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিবের একটি রিপোর্ট পঠিয়ে রামলালার মূর্তি মসজিদ থেকে সরানো যে অসম্ভব, সে কথা সাফ জানিয়ে দেন। সর্দার পটেলও সেটাই চেয়েছিলেন বলে পন্থ নেহরুকে জানান। এই চিঠি পেয়ে ক্ষুব্ধ নেহরু পন্থকে পালটা চিঠি দিয়ে ১৭ এপ্রিল বলেন, কংগ্রেসের এহেন মহারথীরা সাম্প্রদায়িকতার পক্ষাঘাতে আক্রান্ত দেখে তিনি ব্যথিত। ১৯৫০ সালের ১৮ মে নেহরু বিধান রায়কে চিঠি লিখেও বলেন, বাবরের তৈরি মসজিদের দখল নিয়েছে কিছু পান্ডা ও সন্ত। কিন্তু এই অযোধ্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে উত্তরপ্রদেশ সরকার চূড়ান্ত ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বিধান রায় নেহরুর পাশে ছিলেন। নেহরুর প্রশ্ন ছিল, নতুন ভারত গঠনের জন্য অযোধ্যার এই সাম্প্রদায়িকতাকে জিইয়ে রাখা কতটা জরুরি?

আডবাণী পরে বলেছেন যে, বাবরি মসজিদ ভাঙার কোনও কর্মসূচি তাঁর ছিল না। ওই আকস্মিক ঘটনায় তিনি এতটাই ব্যথিত হন যে, যাঁরা তাঁকে লাড্ডু খাওয়াতে আসেন, তিনি তাদের কাছ থেকে সেই মিষ্টান্ন গ্রহণে রাজি হননি। প্রমোদ মহাজন এসে ক্ষুব্ধ আডবাণীকে তাড়াহুড়ো করে অযোধ্যা থেকে লখনউ নিয়ে চলে আসেন। আডবাণী নিজেই আমাকে বলেন, অনেক সময় গণ আন্দোলনে নেতৃত্ব নিয়ন্ত্রণ হারায়। ৬ ডিসেম্বর তাই হয়েছিল। আডবাণী নিজে ষড়যন্ত্র করে বাবরি মসজিদ ভেঙে দিলেন, এ কথাও আজও আমি বিশ্বাস করি না। তবু আজ ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর এ কথা বলতে আমি বাধ্য আধুনিক ভারত গঠনের জন্য আডবাণীর এই আন্দোলনের কোনও প্রয়োজন ছিল না।

দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের সঙ্গে নেহরুর চিঠি-চাপাটি চলত। রাসেল লিখেছিলেন, ১৯৪৭ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়েই নেহরুর উচিত ছিল, গোঁড়া হিন্দু দক্ষিণপন্থীদের তাড়িয়ে দেওয়া। তাতে কংগ্রেস ভেঙে গেলে ভেঙে যেত। নেহরুকে সারাজীবন দলের ভিতর লড়াইটা করতে হত না। আমার অবশ্য মনে হয়, নেহরু দলের মধ্যেই রক্ষণশীলদের রেখে ভারত গঠনে তাঁদের অপ্রাসঙ্গিক করতে সমর্থ হয়েছিলেন। পরে এ দেশে বিজেপির শক্তি বেড়েছে, সাম্প্রদায়িকতার বিপদও বাড়তে বাড়তে আমরা এসে পৌঁছেছি এই অসহিষ্ণু সময়ে।

২৫ বছর পর আজ আরও একটা ৬ ডিসেম্বরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারছি শাসক দল এক নতুন ভারতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। সে ভারত আমার-আপনার ভারত নয়, সে ভারতের সঙ্গে সনাতন ভারতের সংঘাত রয়েছে।

ভারত-ইতিহাসে শুধু অহিংসার ললিত বাণী নয়, হিংসাও ছিল। তবু মহাভারতের যুদ্ধ থেকে কলিঙ্গ যুদ্ধ, বার বার জিতেছে অহিংসা। আজও আমার বিশ্বাস, দুই ভারতের সংঘাতে পরাস্ত হবে বিভেদের ভারত। শেষ পর্যন্ত জিতবে বুদ্ধ-অশোক-আকবর থেকে চৈতন্য-গাঁধী-নেহরু-রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ভারতই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন