সন্তোষী কুমারী। ছবি:সংগৃহীত।
যোগী আদিত্যনাথ বলেছেন বিশ্বের পর্যটন মানচিত্রে তিনি রামের জন্মস্থান অযোধ্যাকে নিয়ে যাবেন। রামমন্দির নির্মাণকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সাধু বাহিনী গত দু’বছর ধরে রামমন্দির নির্মাণের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাথর আনার কাজ চালাচ্ছে।
তাজমহল নিয়েও বিতর্ক শুরু হয়েছে। সঙ্ঘ পরিবারের বক্তব্য, তাজমহল মুসলিম শাসকের সৃষ্টি। তাকে আমরা অহেতুক গুরুত্ব দেব কেন? উত্তরপ্রদেশ সরকারের পর্যটন মানচিত্র থেকে তাজমহলকে বাদ দেওয়ার চেষ্টাও শুরু হয়েছে। সরকারি পর্যটন পুস্তিকায় নেই তাজমহলের নাম। কেউ কেউ তো এই বিতর্কে অংশ নিয়ে তাজমহল ভেঙে ফেলার পরামর্শ দিয়েছেন।
বিজেপির উত্তরপ্রদেশের বিধায়ক সঙ্গীত সোম ১৫ অক্টোবর মেরঠে জনসভা করে শাহজাহানের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে বলেন, “কীসের ইতিহাস? তাজমহল পর্যটন ব্রোসার থেকে থেকে বাদ গেলে কারা কাঁদছেন? ওই লোকটা উত্তরপ্রদেশ ও ভারতের হিন্দুদের ভুলে গিয়েছিল আজ তাকে মনে রাখতে হবে?” নতুন করে ইতিহাস রচনা করতে চাইছে এ সরকার। আকবর, আওরঙ্গজেব থেকে বাবর— সরকার এঁদের নাম বাদ দিয়ে রাম থেকে কৃষ্ণ, মহারানা প্রতাপ থেকে শিবাজি রাও— এঁদের ইতিহাস রচনা হবে। এখানেই শেষ নয়। আরএসএস মতাবলম্বী ঐতিহাসিক পিএন ওক আগেও লিখেছেন, এখনও ইতিহাস গবেষণা ভারতীয় পরিষদে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে তাজমহল আগে একটি শিবমন্দির ছিল কি না! বিনয় কাটিয়ার নিজেও এ সব কথা বলে আবার তাঁদের ভোটব্যাঙ্ক ভক্তবাহিনীতে উত্তেজনা সৃষ্টি করেন।
সর্দার বল্লভভাই পটেলের বিরাট উঁচু মূর্তি তৈরি হবে অমদাবাদে। প্রধানমন্ত্রী হয়েই নরেন্দ্র মোদী এ কথা ঘোষণা করেন। এক দিকে গুজরাতের অস্মিতা, অন্য দিকে নেহরু মডেলটির প্রতি অনাস্থা প্রকাশ, এ এক অদ্ভুত রাজনৈতিক মানসিকতা। আইফেল টাওয়ারকে টেক্কা দিতে টোকিও টাওয়ার হয়। নেহরুকে খর্ব করার জন্য পটেলকে তুলে ধরা। চার্লি চ্যাপলিনের ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ দেখেছেন? হিটলার ও স্তালিনের কল্পিত সাক্ষাত্কার? টেবিলের দু’দিকে দু’জনে। কে কত উঁচুতে বসতে পারেন। ক্রমাগত সেলুনের চেয়ারের মতো চেয়ারটির চাকা ঘুরিয়ে ক্রমাগত এক জন আর এক জনের উপরে উঠছেন।
এ তো গেল একটা দিক। অন্য দিকটিতে কী আছে? সে দিকটিতে আছে ক্ষুধা সম্পর্কিত রিপোর্ট। ইন্টারন্যাশনাল ফু়ড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট বিশ্বস্তরে ১১৯টি দেশে ক্ষুধার উপর সমীক্ষা চালায়। দেখা যাচ্ছে ১১৯টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১০০ নম্বরে। এ বার ঝাড়খণ্ডের সিমডেগা জেলায় বছর এগারোর মেয়ে সন্তোষী কুমারী খাবারের অভাবে মারা গেল। দেখা যাচ্ছে, ওদের পরিবারে আধার কার্ড তো দূরের কথা, কোনও রেশন কার্ডই নেই। বাড়িতে কোনও খাদ্য নেই। বিজেপি শাসিত রাজ্য। কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক দল জানিয়েছে মৃত্যুর ঘটনা সত্য, কিন্তু খাদ্যের অভাবে মৃত্যু হয়েছে এ কথা সত্য নয়। বিরোধী কংগ্রেস নেতা সুবোধকান্ত সহায় বলেছেন, “শাসক দল বিজেপি কেন্দ্রে, তাই রাজ্য সরকারকে বাঁচানোর চেষ্টা চলছে। অতএব সন্তোষীর মৃত্যুর পরও রাজনৈতিক বিতর্ক চলছে, এটি অনাহারে মৃত্যু নাকি ম্যালেরিয়ায়!
গোরক্ষক তাণ্ডবের পর অযোধ্যা-তাজমহল বিতর্ক। একে কি বলা যায় ‘অচ্ছে দিন’?— ফাইল চিত্র।
যে দিন সন্তোষীর মৃত্যুর খবর এল ঠিক সে দিন অর্থাত্ দীপাবলির ঠিক এক দিন আগে বিভিন্ন চ্যানেল ও সংবাদমাধ্যমে একটি খবর দাপিয়ে বেড়াল। তা হল পুরাণকে সত্য করে তোলার খবর। হেলিকপ্টার নামক পুষ্পক রথে করে অযোধ্যায় নামলেন রামচন্দ্র ভ্রাতা লক্ষ্মণ এবং সীতা। অযোধ্যার সরযূ নদীর তীরে লাখ লাখ প্রদীপ জ্বলল। সরকারি খরচে সরযূ নদীর তীরে ১ লক্ষ ৮৭ হাজার ২১৩টি প্রদীপ জ্বলল। টিভি চ্যানেলে লাইভ অনুষ্ঠান, উপস্থিত মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ।
গোটা বিশ্বের নানা দেশে আর্থিক অসাম্যর উপর একটি সমীক্ষা রিপোর্ট সম্প্রতি আমাদের হাতে এসেছে। ১৮০টি দেশের মধ্যে আর্থিক অসাম্যে ভারত এখন ১৩৫তম স্থানে। মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রশ্নে ১৮০টি দেশের মধ্যে আমরা ১৩০তম স্থানে। অতএব, এই যে আর্থিক বৃদ্ধির রণহুঙ্কার, কর কাঠামো সংস্কার ও আর্থিক উন্নয়ের কথা গত তিন বছর ধরে শুনে আসছি, আর্থিক বৃদ্ধির শর্তাবলীতেও পরিবর্তন করা হল, তার পর কী হল? আর্থিক বৃদ্ধির পশ্চাত্মুখীনতা।
মানবসম্পদ, ক্ষুধা এবং আর্থিক অসাম্য সম্পর্কিত রিপোর্ট— সব কিছুতেই নেতিবাচক তথ্য। শতকরা এক ভাগ মানুষ পুরো দেশের ৫৮ ভাগ সম্পদের মালিক। শতকরা ১০ ভাগ মানুষ ৮০ ভাগ সম্পদের মালিক।
আর ঠিক এই দৃশ্যের পাশেই আমরা দেখছি আমাদের দেশে বুলেট ট্রেন এল বলে, প্রথমে অমদাবাদ থেকে মুম্বই, তার পর তো গোটা দেশেই হবে। অতএব লভ জিহাদ, গোরক্ষাবাহিনীর তাণ্ডব, মন্দির-মসজিদ— এই বিতর্ক দীর্ঘজীবী হোক।
হায়! অমর্ত্য সেন সেই কবে থেকে বলছেন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী এসে অনেক কাউন্টার ন্যারেটিভের কথা বলছেন। তা হলে এই অযোধ্যা-তাজমহল বিতর্ক আর গোরক্ষক তাণ্ডব ইত্যাদি ইত্যাদি এ সব প্রচারেই কেন দাপট আমাদের সংবাদমাধ্যমে? একে কি বলা যায় ‘অচ্ছে দিন’?