ফেসবুককে কেন ডাকাই যায়

ভারতে এখনও তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কোনও নির্দিষ্ট আইন নেই। সুপ্রিম কোর্ট গোপনীয়তার অধিকারকে ব্যক্তির মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

Advertisement

শমীক সেন

শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৮ ০০:২১
Share:

রবিশংকর প্রসাদ যেই না হুমকি দিয়েছেন যে, কোনও ভারতীয়ের ফেসবুক তথ্য চুরি হলে মার্ক জুকেরবার্গকে ডেকে পাঠাবেন, অমনি মস্করার বান ডেকেছে, ‘নীরব মোদীকে ফেরাতে পারে না, জুকেরবার্গকে ডাকবে!’ ললিত মোদী, বিজয় মাল্য, দাউদ ইব্রাহিম, হাফিজ সইদ, ডেভিড হ্যাডলি, কাউকেই তো দেশে ফেরাতে পারেনি ভারত। তা হলে? ‘কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা’ কেলেঙ্কারির খবর প্রকাশ পাওয়ার পরেই প্রসাদের হুমকিটি কি নেহাত ফাঁপা আওয়াজ?

Advertisement

ভারতে এখনও তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কোনও নির্দিষ্ট আইন নেই। সুপ্রিম কোর্ট গোপনীয়তার অধিকারকে ব্যক্তির মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তথ্যের গোপনীয়তা প্রশ্নাতীত ভাবে তার অংশ। কিন্তু, এখনও কোনও নির্দিষ্ট আইন তৈরি হয়নি। তবে যে আইন আছে, তাতেই তথ্যচুরির জন্য শাস্তি দেওয়া যায়। ২০০০ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইনেই সেই ব্যবস্থা আছে। মানুষের গোপন, ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা রক্ষায় কোনও সংস্থার গাফিলতির ফলে যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কোনও ক্ষতি হয়, বা অন্য কেউ যদি অন্যায় ভাবে লাভ করে, তবে সংস্থাটিকে দোষী সাব্যস্ত করা যায়। আইনের ৪৩এ ধারায় তার থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের বিধান রয়েছে। চুক্তির তথ্য ফাঁস করে শাস্তির ব্যবস্থা আছে আইনের ৭২এ ধারায়। তা ছাড়াও, ২০১১ সালের ইনফর্মেশন টেকনোলজি (রিজনেব্‌ল সিকিয়োরিটি প্র্যাকটিসেস অ্যান্ড প্রসিডিয়রস অ্যান্ড সেনসিটিভ পার্সোনাল ডেটা অর ইনফর্মেশন) রুলস-এ ভারতে সাইবার ডেটা নিরাপত্তার ব্যবস্থার বিস্তারিত বিধান রয়েছে।

তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৭৯ ধারায় (২০০৮ সালে সংশোধিত, ধারাটি ‘ইন্টারমিডিয়ারি লায়াবিলিটি’ বা ‘মধ্যস্থতাকারীর দায়বদ্ধতা’র ধারণাটিকে প্রতিষ্ঠা করে) এবং ২০১১ সালের ইনফর্মেশন টেকনোলজি (ইন্টারমিডিয়ারি গাইডলাইনস) রুলস-এর তিন নম্বর নিয়ম— এই দুটি বিষয় বর্তমান আলোচনায় অতি তাৎপর্যপূর্ণ। ইলেকট্রনিক নথির ক্ষেত্রে ইন্টারমিডিয়ারি বা মধ্যস্থতাকারী কাকে বলে? কোনও ব্যক্তির হয়ে অন্য কোনও ব্যক্তি বা সংস্থা যদি তথ্য গ্রহণ করে, জমা রাখে বা দেয়, এবং সেই তথ্যের ভিত্তিতে কোনও পরিষেবা দেয়, তবে সেই ব্যক্তি বা সংস্থা হল মধ্যস্থতাকারী। টেলিকম সংস্থা, নেটওয়ার্ক সার্ভিস প্রভাইডার, ইন্টারনেট সংস্থা, ওয়েব-হোস্টিং পরিষেবা সংস্থা, সার্চ ইঞ্জিন, অনলাইন পেমেন্ট সাইট, অনলাইন দোকান থেকে সাইবার ক্যাফে, সবই মধ্যস্থতাকারী। আইনের সংজ্ঞা অনুসারে ফেসবুকও তাই। ৭৯ ধারা অনুযায়ী, কোনও মধ্যস্থতাকারীর হেফাজত থেকে তথ্য চুরি গেলে যদি দেখা যায় যে সংস্থাটি তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যুক্তিসঙ্গত সব ব্যবস্থাই গ্রহণ করেছিল, নিজে চুরির শরিক নয় বা চুরিতে মদতও দেয়নি, এবং তার সঙ্গে আইনে নির্ধারিত আরও কিছু শর্ত পূরণ করছে, একমাত্র তখনই সংস্থাটির ঘাড়ে সেই চুরির দায় বর্তাবে না। অর্থাৎ, যদি কোনও সংস্থা তথ্যের নিরাপত্তায় গাফিলতি করে, বা চুরিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদত দেয়, ভারতে তার কোনও আইনি রক্ষাকবচ নেই। তথ্যের নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা কী, আইনে তা বলা রয়েছে। এবং, দেখা গিয়েছে, বহু ক্ষেত্রেই যখন সেই ব্যবস্থায় চ্যুতির অভিযোগ উঠেছে, মধ্যস্থতাকারী সংস্থা দ্রুত ভুল শুধরে নিয়েছে। অর্থাৎ, ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি আইনকে যে সংস্থাগুলি সমঝে চলে, তার প্রমাণ রয়েছে।

Advertisement

নীরব মোদী, বিজয় মাল্য, এমনকী দাউদ ইব্রাহিমের ক্ষেত্রেও কিন্তু পরিস্থিতি আলাদা। মোদী বা মাল্যদের ব্যবসায় লালবাতি জ্বলেছে। সেই ব্যবসায় তাঁদের আর আগ্রহ নেই। অন্য দিকে, গত জানুয়ারিতে ভারতে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২৫ কোটি। অর্থাৎ, ভারতের আইন মেনে দেশের বাজারে উপস্থিত থাকার যে তাগিদ জুকেরবার্গের, মোদী-মাল্যদের তার তিলমাত্র নয়। তাঁরা বিদেশে থাকতেই চাইবেন, কারণ অভিযুক্ত প্রত্যর্পণে ভারতের অবস্থা মর্মান্তিক।

৪৭টি দেশের সঙ্গে ভারতের প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে, অর্থাৎ এই দেশগুলি ভারতের অভিযুক্তদের অপরাধী হিসাবেই দেখবে। আরও ন’টি দেশের সঙ্গে প্রত্যর্পণ সমঝোতা রয়েছে (অর্থাৎ, দেশগুলি ভারতকে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়ায় সহায়তা করবে)। তার পরেও, ২০০২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ভারত মাত্র ৬২ জন অভিযুক্তকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পেরেছে। ১২১টি মামলা এখনও ঝুলে রয়েছে। পরিসংখ্যানটি বিদেশ মন্ত্রকের। কিছু ক্ষেত্রে ভারতের অনুরোধ নাকচ হয়েছে, সেই হিসাব এই পরিসংখ্যানে নেই। আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে এ-অবধি ফিরিয়ে আনা গিয়েছে তিন জনকে।

কেন ভারত বিদেশ থেকে অভিযুক্তদের ফিরিয়ে আনতে পারে না? কারণ একাধিক। ভারত-ব্রিটেন অভিযুক্ত প্রত্যর্পণ চুক্তির কথাই ধরা যাক। ১৯৯৩ সালে চুক্তিটি হয়েছিল। এ-যাবৎ ফিরিয়ে আনা গিয়েছে মাত্র এক জন অভিযুক্তকে: সমীরভাই বিনুভাই পটেল, গুজরাত দাঙ্গায় অভিযুক্ত। তা-ও, তিনি নাকি প্রত্যর্পণের বিরোধিতাই করেননি। এই একটি ব্যতিক্রম বাদে ভারতের প্রতিটি অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, তা হান্সি ক্রোনিয়ে-র ম্যাচ গড়াপেটা কাণ্ডে অভিযুক্ত সঞ্জীব চাওলারই হোক বা বিজয় মাল্যের। মাল্যের ক্ষেত্রে ২০১৬ সালে প্রথম যে অনুরোধটি করা হয়, তাতে কাণ্ডজ্ঞানের অভাব প্রকট। কর্পোরেট আইনের গোড়ার কথা হল, কোনও সংস্থার আইনি অস্তিত্ব তার প্রতিষ্ঠাতার আইনি অস্তিত্বের থেকে স্বতন্ত্র। ভারত মাল্যকে ফিরিয়ে আনতে ব্রিটেনের কাছে প্রথম যে আবেদনটি করল, তার ভিত্তি ছিল এই যে, ঋণের টাকা ফেরত দিতে মাল্যের সংস্থা ব্যর্থ হয়েছে। স্বভাবতই ব্রিটেন সে-আবেদন প্রত্যাখ্যান করল। ঢের গড়িমসির পর ২০১৭’য় ভারত ফের আবেদন করল, এ বারের অভিযোগ আর্থিক জালিয়াতির। এ ক্ষেত্রেও এমন সব প্রমাণের ওপর ভরসা রেখেছে ভারত সরকার, যা এই দেশের আদালতেই ধোপে টিকবে না।

কিছু প্রাতিষ্ঠানিক কারণও আছে। সঞ্জীব চাওলার ক্ষেত্রে আবেদনটি প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল ভারতের জেলখানার খারাপ অবস্থার কারণে। ভারতে এখনও প্রাণদণ্ড চালু আছে, এই কারণেও একাধিক দেশ অপরাধী প্রত্যর্পণের আবেদন নামঞ্জুর করে। এবং, ভারতের কূটনৈতিক ব্যর্থতা ও কিছু ক্ষেত্রে কূটনৈতিক সদিচ্ছার অভাবও অপরাধীদের ফিরিয়ে আনার পথে মস্ত বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কথাগুলো নীরব মোদীরাও জানেন।

ফেসবুক আর মোদী-মাল্যদের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এক দিকে রয়েছে এমন আইন, যা মাঝে-মাঝে অতিরিক্ত কঠোর হয়ে ওঠে। অন্য দিকে, প্রাতিষ্ঠানিক চেষ্টা ও দক্ষতার বিপুল অভাব।

ওয়েস্ট বেঙ্গল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জুরিডিকাল সায়েন্সেস, কলকাতা-য় আইনবিদ্যার শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন