বুঝিয়ে দে, বুঝিয়ে দে

কিছু দিন ধরে নানা খবরে দেখছিলাম দেশের অপরাধ দমনের জন্য সেন্ট্রাল বুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই) নামে যে কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান আছে সেখানে কী যেন সব গোলমাল চলছে। কে যেন বহিষ্কৃত হচ্ছেন, আবার বহিষ্কৃত জন ফিরে আসছেন, প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা পরস্পরের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ করছেন।

Advertisement

কৃষ্ণা বসু

শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share:

আঁধার রাতে একলা পাগল যায় কেঁদে।/ বলে শুধু, বুঝিয়ে দে, বুঝিয়ে দে, বুঝিয়ে দে।— রবীন্দ্রনাথের সুপরিচিত এই গানের কলি কিছু দিন ধরেই মনের মধ্যে কেবলই গুনগুন করে। সকাল বেলায় যখন খবরের কাগজ খুলে বসি অথবা সন্ধ্যায় টেলিভিশনের পর্দায় খবরে চোখ রাখি তখন এমন সব ঘটনা দেখি যার অর্থ ঠিক বোধগম্য হয় না। তখন সেই আঁধার রাতের একাকী মানুষটির মতো ইচ্ছে হয়— বুঝিয়ে দে, বুঝিয়ে দে।

Advertisement

কিছু দিন ধরে নানা খবরে দেখছিলাম দেশের অপরাধ দমনের জন্য সেন্ট্রাল বুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই) নামে যে কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান আছে সেখানে কী যেন সব গোলমাল চলছে। কে যেন বহিষ্কৃত হচ্ছেন, আবার বহিষ্কৃত জন ফিরে আসছেন, প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা পরস্পরের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ করছেন। আগে জানতাম কেন্দ্রে সিবিআই এবং রাজ্যে ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)-এর ওপর দেশের নিরাপত্তা নির্ভর করে। শুধু দেশের ভিতরে অপরাধপ্রবণতা নয়, কোনও বিদেশি ষড়যন্ত্রকারী নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে কি না সে দিকে রাখতে হয় সতর্ক দৃষ্টি। এই রকম একটি সংবেদনশীল প্রতিষ্ঠানে কেন এত গুরুতর গন্ডগোল চলতে দেওয়া হচ্ছে তা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এরই মধ্যে অকস্মাৎ সিবিআই ও সিআইডি, দু’টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যে সংঘাত বেধে গেল তা দেখে চক্ষু স্থির!

মাঝে মাঝে ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে নানা রকম কলঙ্কজনক ঘটনার কথা লোকপরম্পরায় কানে এসেছে। এর সত্য-মিথ্যা যাচাই সাধারণ মানুষের কাজ নয়। দ্রুত তদন্ত করে যিনি নিষ্কলঙ্ক তাঁকে অপবাদমুক্ত করা, যিনি শাস্তিযোগ্য তাঁর শাস্তিবিধান জরুরি ছিল। কিন্তু অবহেলায় অনেক জল গড়িয়ে যেতে দেওয়া হল। সেটাও যেমন সাধারণ বুদ্ধিতে ব্যাখ্যা করা যায় না, তেমনই অকস্মাৎ ঘুম থেকে উঠে সকল অপরাধীকে এই বিশেষ মুহূর্তে শাস্তি দিতে হবে— এই অতিতৎপরতাও জনমানসে প্রশ্ন তুলতে বাধ্য। এর ফলে আজ আমরা এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে উপনীত হয়েছি। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে যে সব ভারতীয় ব্রিটিশের অনুগত ছিলেন তাঁরা ভয় দেখাতেন, ইংরেজ চলে গেলেই নাকি ভারত, অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। স্বাধীনতার পর সাত দশকের বেশি সময় কেটে গিয়েছে, তেমন অঘটন ঘটেনি। ভারতের সংবিধান, ভারতের গণতন্ত্র বিপন্ন হয়নি।

Advertisement

এক সময়ে সংসদের বিদেশ মন্ত্রক কমিটিতে যুক্ত থাকার সুবাদে দেশবিদেশের প্রতিনিধিদলের কাছে প্রশংসাবাক্য শুনেছি। তাঁরা বলেছেন, আপনারা কেমন সুন্দর গণতন্ত্র রক্ষা করেছেন, আপনাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, কেউ পারেনি। শুনে অহঙ্কারে গদগদ হতাম। সেই অহঙ্কারে কোথায় যেন ঘা লেগেছে। স্বাধীনতা লাভের পর আমাদের সংবিধান যাঁরা রচনা করেছিলেন তাঁরা অত্যন্ত প্রাজ্ঞ ছিলেন। অনেক কষ্টে অর্জন করা স্বাধীনতা, এক দিকে মহাত্মা গাঁধীর অহিংস অসহযোগ আন্দোলন, অন্য দিকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বিকল্প নেতৃত্বে রণক্ষেত্রে সশস্ত্র সংগ্রাম। আরও কত জানা-অজানা বিপ্লবী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে আত্মত্যাগ করেছিলেন। সংবিধান প্রণেতারা তাঁদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। দেশের মানুষের মঙ্গল ছিল তাঁদের কাম্য। গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত করার জন্য তাঁরা কতকগুলি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানের কথা ভেবেছিলেন, যথা নির্বাচন কমিশন। আজকের দিনে কেন্দ্রে অথবা রাজ্যে কমিশনগুলির নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালন কঠিন হয়ে পড়েছে। বিচারব্যবস্থার বরাবর ছিল আলাদা মর্যাদা। আজও মানুষ শেষ পর্যায়ে আশ্রয় খোঁজেন সেখানে।

আরও কত সময়ে যে বিভ্রান্তবোধ করেছি আর অসহায় ভাবে ‘বুঝিয়ে দে’ বলতে ইচ্ছে হয়েছে! ক’দিন আগে কেন্দ্রীয় সরকার তাদের শেষ বাজেট পেশ করল। নির্বাচন আসন্ন। আগামী মে মাসে নবনির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করবে। পুরাতন সরকার ফিরবে অথবা নূতন কেউ আসবে, তা ভবিষ্যতের গর্ভে। পয়লা ফেব্রুয়ারি যে বাজেট পেশ হল তাতে প্রায় আগামী তিন দশক ধরে দেশের আর্থিক নীতি সম্পর্কে অনেক ঘোষণা করা হল। আমি সাংসদ থাকাকালীন ঘনঘন সরকার পড়ে যেতে দেখেছি, বার বার নির্বাচনে যেতে হয়েছে। তখন দেখতাম অর্থমন্ত্রী একটি ভোট-অন-অ্যাকাউন্ট পেশ করতেন। তাতে এই সংসদ ভেঙে যাওয়ার সময় থেকে পরবর্তী, নবনির্বাচিত সরকার কার্যভার গ্রহণ করা পর্যন্ত দেশের আর্থিক ব্যবস্থা কেমন চলবে, তার কথা থাকত। এ বারের বাজেট মনে হল পূর্ণাঙ্গ বাজেট। কী জানি! হয়তো বুঝে উঠতে পারিনি।

দেশবাসীর সুরক্ষার জন্য আছে আরও নানা রকম প্রতিষ্ঠান। মহিলা কমিশন, শিশু কমিশন, মানবাধিকার কমিশন। কোনও দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটলে তারা ‘পরিদর্শন’-এ যায়। এই প্রতিষ্ঠানগুলির যে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করার ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন, ‘পরিদর্শন’-উত্তর ফলাফলে তা নিশ্চিত নয়।

মহাপুরুষেরা বলে গিয়েছেন ‘হতাশ’ হওয়া পাপ। অতএব আশায় বুক বেঁধে আছি। মনে হয় আমি একা নই, আমার মতো আরও অনেকে আছেন, যাঁরা রবীন্দ্রনাথের সেই আঁধার রাতের একাকী মানুষটির মতো বিভ্রান্ত বোধ করছেন। তাঁদের সঙ্গে আমার এই আকুতি ‘বুঝিয়ে দে’ ভাগ করে নিলাম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন