কোন মানুষ আন্তর্জালে কী সাইট দেখিতেছেন, সেই তথ্য সংগ্রহ করিয়া নাকি বিক্রয় করা হইতেছে, তাহা কিনিয়া বিভিন্ন সংস্থা ঠিক করিতেছে: কোথায় বিজ্ঞাপন দিয়া কোন ধরনের মানুষকে নিজেদের পণ্য কিনিতে উৎসাহ দেওয়া যাইবে। আপাত ভাবে ইহার মধ্যে অন্যায় কিছু নাই, কারণ সব মানুষই সহস্র সাইট দেখিয়া বেড়াইতেছেন সমগ্র দিন, কেহ যদি জানিয়াও লয়, তিনি কী দেখিতে-শুনিতে ভালবাসেন, ক্ষতি কী? মুশকিল হইল, এই মুহূর্তে এই প্রকারে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে জার্মানির দুই গবেষক দাবি করিতেছেন, ওই দেশের এক বিচারক ঘন ঘন পর্নোগ্রাফিক সাইট দেখেন, এক রাজনীতিক মাদকের সন্ধান করেন। মানুষ যখন আন্তর্জালে ঘুরিতেছে, সে আপনমনে যাহা ইচ্ছা তাহা করে, শহরের পথে ঘুরিয়া বেড়াইবারই ন্যায়, ইচ্ছা হইলে মন্দিরে যায়, বা দোকানের জানালায় অন্তর্বাসের দিকে হাঁ করিয়া তাকায়। যদি এক গুপ্তচর সর্ব ক্ষণ তাহাকে অনুসরণ করিতে থাকে, ব্যক্তিগত সময় কাটাইবার সমগ্র প্রক্রিয়াটিই তিক্ত হইয়া যায়। বিচারক তাঁহার নিজস্ব সময়ে পর্নোগ্রাফিক সাইটে যাইবেন না কচ্ছপের কোষ বিশ্লেষণ করিবেন তাহা নিতান্তই তাঁহার ব্যক্তিগত ব্যাপার। সেইখানে জেঠামহাশয়গিরি করিবার অধিকার কাহারও নাই। বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে যদি অকস্মাৎ সর্বাঙ্গীণ নজরদারি শুরু হইয়া যায়, অচিরেই তাহা অন্য কার্যে ব্যবহৃত হইতে পারে, রাষ্ট্র তথ্যগুলি কিনিয়া বিভিন্ন মানুষের সম্পর্কে ফাইল প্রস্তুত করিতে পারে এবং রাষ্ট্রের সরব নিন্দুকের ব্যক্তিগত অভ্যাসের বিবরণ প্রকাশ্যে আনিয়া তাহাকে অপদস্থ করিতে পারে। যে কোনও ব্যক্তিকে সম্ভাব্য ব্ল্যাকমেল করিবার উপকরণ হিসাবে এই তথ্যগুলি কিনিয়া লইতে পারে রাজনৈতিক দল, বা অফিসের কর্তৃপক্ষ।
প্রযুক্তির বিস্ফোরণ ঘটিবার সহিত নজরদারির সম্ভাবনারও বিস্ফোরণ ঘটিয়াছে। মানুষ এখন পারিলে নিজের প্রতিটি জাগ্রত মুহূর্তই ক্যামেরায় বা ফেসবুকে বা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে নথিবদ্ধ করিয়া রাখে। কে কখন লুচি খাইয়াছিল, সন্তানকে লইয়া মল-এ গিয়াছিল, তাহা তো বটেই, বহু যুগল নিজেদের ঘনিষ্ঠতম মুহূর্তও মোবাইলে তুলিয়া রাখিতেছে। এইগুলি বহু সময়ে ফাঁস হইয়া যায়, এবং কাহারও সামাজিক জীবনে সর্বনাশ ঘটিয়া যায়। অপরাধ বুঝিতে সর্বত্র ক্লোজ-সার্কিট ক্যামেরা বসাইবার যে প্রচলন হইয়াছে, তাহার দাপটে বহু মানুষের পরকীয়া খচিত হইয়া যায়। কিছু বৎসর পূর্বে লন্ডনের এক বাজারের বিভিন্ন কোণ হইতে নজরদারি ক্যামেরা সরাইয়া লওয়া হয়, কারণ তাহাতে বহু মানুষের অজ্ঞাতসারে তাহাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা বিঘ্নিত হইতেছিল। কিন্তু সেই উদারতা বিসর্জন দিয়া, সমগ্র পৃথিবীটিই ‘স্টিং অপারেশন’-এ ভরিয়া যাইতে দেরি নাই। ডিজিটাল যুগ মানুষকে নথিবদ্ধ জীব করিয়া তুলিয়াছে, এবং ক্ষমতা থাকিলে মানুষটির সকল তথ্য কিনিয়া, তাহার কার্যকলাপ আন্দাজ করিতেও পারা যাইবে, অতি ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস করিবার ভয় দেখাইয়া কিছু কার্য হইতে তাহাকে বিরত করাও যাইবে।
প্যানঅপটিকন তত্ত্ব অবশ্য বলে, যদি মানুষ জানে যে তাহার উপর প্রতিটি মুহূর্তেই কেহ নজর রাখিতেছে, তাহা হইলে সে নিজেই নিজের উপর নজরদারি শুরু করিয়া দেয়। অর্থাৎ, ধরা পড়িবার ভয়ে সে এমন কিছুই করে না, যাহা কর্তৃপক্ষের নিন্দার্হ। মানুষ যখন বুঝিবে, তাহার সকল প্রেমালাপ কেহ না কেহ পড়িতেছে, সকল যৌন আস্ফালন কেহ না কেহ দেখিতেছে, সকল ব্যক্তিগত উদ্ভট শখ কেহ না কেহ মাপিতেছে, তখন সে হয়তো ক্রমে নিজের সকল নিজস্বতা হইতে সরিয়া আসিবে। শখ বিসর্জন দিবে, অতি সংযত ভাবে প্রেম করিবে। স্বতঃস্ফূর্তি হইতে তাহার এই নির্বাসন তাহাকে কম মনুষ্য ও অধিক নাগরিক করিবে। অথবা, আত্মরক্ষার তাগিদে, মানুষ তাহার চিন্তাতরঙ্গের অনুবাদ ডিজিটাল মাধ্যমে আর করিবেই না, ফিরিয়া যাইবে পূর্বের ন্যায় চিঠিপত্রে, কথোপকথনে, ডাইরিতে, অথবা নিজস্ব নীরবতায়। বহু মুহূর্তেই ত্যাগ করিবে মোবাইল। অবশ্য এমন আইন হয়তো আর দূরে নাই, যাহার বলে প্রতি অনুপলে মোবাইল সঙ্গে রাখা হইবে বাধ্যতামূলক, আধার কার্ড না লইয়া কলঘরে গেলে পুলিশে ধরিবে। তখন নিজের মতো করিয়া বাঁচাই হইবে মানুষের গুপ্ত জঙ্গি আন্দোলন! আশা করা যায়, এই পরিস্থিতি লইয়া ফেসবুকে সাহিত্য করিতে পারিলে রাষ্ট্র ‘জর্জ অরওয়েল পুরস্কার’ দিবে, সঙ্গে নগদ ১৯৮৪ টাকা!
যৎকিঞ্চিত
বহু রাস্তায় প্যান্ডাল তৈরি শুরু, গাড়ি চলার ঝামেলাও। কোন পুজোয় কী থিম, উদ্বোধন করবেন জয়া এহসান না ঝুলন গোস্বামী, চুলচেরা তক্কোও নির্ঘাত ধীরে মাথা তুলছে। কিন্তু ধর্মপ্রাণ লোকের কলজে শুকিয়ে গিয়েছে আসল কথা ভেবে। উমা তো পাহাড় থেকে নামবেন। পাহাড়ে যা গন্ডগোল শুরু হয়েছে, উনি আদৌ এসে পৌঁছতে পারবেন তো? না কি তার জন্য স্পেশাল যুদ্ধবিরতির আর্জি জানাতে হবে? সে কাজে কি পাহাড়ী সান্যালের মুখ ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন দিলে সুবিধে?!