প্রাণদণ্ড ভাল না খারাপ? যুক্তি এবং পাল্টা যুক্তিগুলো বার বার শুনে শুনে আমাদের খুব চেনা হয়ে গিয়েছে। আমরা জেনে গিয়েছি, মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে ও বিপক্ষে রকমারি তত্ত্ব আর বিস্তর তথ্যের সওয়াল-জবাব মন্থন করে কোনও শেষ উত্তর উঠে আসবে না। প্রশ্নটা থেকেই যাবে।
যাবে তো? ভয় হয়, প্রশ্নটাই হয়তো হারিয়ে যাবে। ইদানীং সে-ভয় দ্রুত বাড়ছে, কারণ এই বিষয়ে প্রশ্নহীন ঐকমত্যের এক অদ্ভুত আঁধার ক্রমে আমাদের গ্রাস করছে। এক দশক আগেও একটা ফাঁসির হুকুম জারি হলে মৃত্যুদণ্ডের ভাল-মন্দ নিয়ে যে-তর্ক শুনেছি, আজকাল তার সিকিভাগও শুনি না। যদি বা কেউ মৃদুস্বরে প্রশ্ন তোলে, অমনি চতুর্দিক থেকে ছুটে আসে সমবেত গর্জন: ফাঁসিই এমন অপরাধের একমাত্র শাস্তি, এই পিশাচদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই, ব্যস! সেই প্রশ্নাতীত বিশ্বাসের যূথশক্তি তর্কটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনও অবকাশই রাখে না।
প্রাণদণ্ডই চরম অপরাধের একমাত্র শাস্তি— এই বিশ্বাস আসে কোথা থেকে? তার কিছু ইঙ্গিত মিলল শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টের রায়ের সূত্রে। সে-রায় পড়তে পড়তে বিচারক যে মুহূর্তে জানালেন, ২০১২ ডিসেম্বরে দিল্লির রাজপথে তরুণীটির ওপর যারা পৈশাচিক অত্যাচার করেছিল, সর্বোচ্চ আদালত তাদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখতে চায়, সঙ্গে সঙ্গে বিচারকক্ষ সমবেত করতালিতে ফেটে পড়ল। বিচারপতির নিষেধ-সংকেতে সেই উচ্ছ্বাস স্তিমিত হয়। আদালত খেলার মাঠ নয়, তার অন্দরে দাঁড়িয়ে হাততালি দেওয়া অনুচিত। কিন্তু স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞান অধুনা এ দেশে সবচেয়ে বেশি দুর্লভ, সুতরাং বিচারকক্ষে সমবেত সুধীমণ্ডলীর কাছে আত্মসংযমের প্রত্যাশা করে লাভ নেই।
আরও পড়ুন:মোদীর হেলিকপ্টারে কেদার যাত্রা এবং বশিষ্ঠমুনির গল্প
গভীরতর প্রশ্ন হল, ফাঁসির হুকুমে এমন পরিতৃপ্ত উচ্ছ্বাস ফেনিয়ে উঠল কেন? শুধু ওই কোর্টরুমের পরিসরেই তো নয়, সুপ্রিম কোর্টের চরম দণ্ডাদেশ ভারতীয় জনজীবনের বিস্তীর্ণ ভুবন জুড়েই একটা পরিতৃপ্তির সঞ্চার ঘটিয়েছে। নির্যাতিত এবং নিহত মেয়েটির মা-বাবা বলেছেন, অপরাধীদের ফাঁসি হলে তাঁরা শান্তি পাবেন। বহু নাগরিক প্রকাশ্যে বা নীরবে তাঁদের কথার প্রতিধ্বনি করেছেন। এই রায়কে তাঁরা অপরাধ ও শাস্তির ভারসাম্য বিধানের মধ্য দিয়ে বিচারপ্রক্রিয়ার পরিসমাপ্তি হিসেবে গণ্য করতে চেয়েছেন। তাঁদের অনুভূতিকে অশ্রদ্ধা করলে অন্যায় হবে।
তবু প্রশ্ন জাগে। অপরাধীর প্রাণ হরণ করলেই অপরাধের বিচার সম্পূর্ণ হয়? যাঁরা মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে প্রবল সওয়াল করেন, তাঁরাও সম্ভবত এ-সংশয় থেকে মুক্ত নন। যে কোনও মৃত্যুদণ্ডের পরেই সেই সংশয় নানা ভাবে নিজেকে প্রকাশ করে। এ বারও তেমনটা ঘটেছে। আদালতের মধ্যেই এক নাগরিকের কণ্ঠে দাবি শোনা গিয়েছে, ফাঁসির আগে অপরাধীদের পুরুষত্ব হরণ করতে হবে। চলচ্চিত্র দুনিয়ার প্রবীণ তারকা সোশ্যাল মিডিয়ায় মন্তব্য করেছেন, ওদের ফাঁসি দেওয়া হোক জনসমক্ষে্। মুহূর্তের মৃত্যু নয়, অনেক যন্ত্রণা দিয়ে মারার বিধান দিয়েছেন কেউ কেউ। কেউ আবার নিপাট সততায় কবুল করেছেন, শুধু ফাঁসিতে এই অপরাধের উপযুক্ত শাস্তি হয় না, কিন্তু কিসে যে হয়, তা-ও তিনি জানেন না, তাই আদালতের এই রায়েই
সন্তুষ্ট থাকছেন।
কথা এটাই। ভয়াবহ নৃশংস পৈশাচিক ইত্যাদি অষ্টোত্তর শত বিশেষণে যে অপরাধকে আমরা, সংগত কারণেই, চিহ্নিত করি, যে অপরাধের কারিগরদের আচরণের কথা ঠিক মতো ভেবে উঠতেও পারি না, তার যথার্থ শাস্তি কী হওয়া উচিত, আমরা জানি না। জানি না, এমন অতল অন্যায়ের সুবিচার বলতে কী বোঝায়। চিন্তা করলেই বুঝতে পারি, কোনও শাস্তিতেই এমন অপরাধের যথার্থ প্রতিকার বা ক্ষতিপূরণ হয় না, হওয়া সম্ভব নয়।
আর ঠিক সেই কারণেই আমরা চিন্তায় ঝাঁপ ফেলে দিই। দিয়ে, নিজেকে প্রবোধ দিই যে, অপরাধীর প্রাণটা কেড়ে নিতে পারলেই অপরাধের বিচার সম্পূর্ণ হল। এই প্রবোধকে আত্মপ্রবঞ্চনা বলে খাটো করতে পারি, কিন্তু তাতে আমাদের অসহায়তকেও খাটো করা হয়। কতখানি অসহায় হলে সন্তান-হারানো জনকজননী ভাবতে পারেন— কন্যার ধর্ষক ও ঘাতকরা ফাঁসিকাঠে ঝুললে তাঁরা শান্তিতে ঘুমোতে পারবেন! নির্মম সত্য এই যে, মৃত্যুদণ্ডের নৈতিকতায় বিশ্বাসটাই তাঁদের সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা। এই বিশ্বাসটুকু কেড়ে নিলে কী নিয়ে বাঁচবেন তাঁরা? আমরাই বা কী নিয়ে বাঁচব?
প্রশ্ন নিয়ে। প্রশ্নশীলতা নিয়ে। যে প্রশ্নশীলতা আমাদের চরমতম যন্ত্রণার মধ্যেও অসহায় বিশ্বাসের কাছে আত্মসমর্পণ করতে দেবে না, ‘মৃত্যুদণ্ড চাই, ব্যস’ বলে নিশ্চিন্ত প্রত্যয়ে চিৎকৃত হতে দেবে না, ফাঁসির আদেশ শুনে বেমালুম করতালিতে মেতে উঠতে দেবে না, অপরাধ ও শাস্তির ভারসাম্য নিয়ে, বিচারের নৈতিক দাবি ও শর্ত নিয়ে ভাবতে বাধ্য করবে। কে মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে, কে নয়, সে বিষয়ে নিজের মন কী বাত নিজেই বলব, অন্তত যত দিন না সেই অধিকারটুকুও ছাপ্পান্ন ইঞ্চি রাষ্ট্রের কব্জায় চলে না যায়। কিন্তু যে যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখান থেকেই তর্কটা চালিয়ে যাওয়া জরুরি। তা না হলে হাততালি ছাড়া আর কিছুই হাতে থাকবে না।