জুনেইদ হত্যা আর ‘নট ইন মাই নেম’-এর পর প্রশ্নটা আবার মাথা চাড়া দিয়েছে। বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদ কি নির্বাচিত প্রতিবাদ নয়? জুনেইদের কথা বলতে গেলে সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা তালিকা হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেই তালিকাও তো দীর্ঘই। এ কথাও তো মেনে নিতেই হয় যে, ক্রান্তিকালে বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে যে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের প্রত্যাশা থাকে, অনেক সময়েই তা পূর্ণ হয় না। নির্বাচিত প্রতিবাদের বিরুদ্ধে যাঁরা কথা বলছেন, তাঁদের অনেকেই তাই দু’চোখ খুলে এই কর্কটক্রান্তির দেশটিকে দেখতে বলছেন। কেউ কেউ আবার এগিয়ে যাচ্ছেন আরও এক কদম। আক্রান্ত মুসলমানের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে বলছেন, মারো, আমাকেও মারো, আমিও মুসলমান। আবার একই ভঙ্গিতে, আক্রান্ত হিন্দুর পাশে দাঁড়াতে গিয়েও বলছেন, মারো, আমাকেও মারো, আমিও হিন্দু। এই নিরপেক্ষতা তো বিপজ্জনক! ধর্মপরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে কি আক্রান্ত মানুষকে দেখা সম্ভব নয়?
কিছু দিন আগে পড়া একটি উপন্যাসের কথা মনে পড়ছে। এক প্রবাসী ভারতীয় কবি কাজিম আলির লেখা উপন্যাসটির নাম ‘দ্য ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স অব শেঠ’। ৯/১১-র পরে আমেরিকায় সংঘটিত ‘হেট ক্রাইম’-এর এক দলিল এই উপন্যাসটি। ৯/১১-র ঠিক পরেই উপন্যাসটির মূল চরিত্র শেঠ-কে আরবের মুসলমান মনে করে আক্রমণ করে কয়েক জন সাদা চামড়ার মার্কিন যুবক। সেই আক্রমণের হাত থেকে শেঠকে রক্ষা করে ইরাকি শিল্পী লায়লা ফুয়াদ। ঘটনাটির বেশ কিছু দিন পরে এক দিন যখন শেঠ লায়লাকে জানায়, ওই আক্রমণের হাত থেকে তাকে রক্ষা করে আসলে লায়লা তার ক্ষতিই করেছিল, লায়লা না এলে সে পাল্টা মার দিতে পারত ওই মার্কিন যুবকদের, তখন তাকে চমৎকার একটি কথা বলে লায়লা। বলে, আসলে আক্রমণের হাত থেকে তাকে বাঁচাবার সময় সে ভাবেইনি, সে শেঠকে রক্ষা করছে। অর্থাৎ, শেঠ-এর জায়গায় যদি অন্য কেউ থাকত, তা হলে তাকেও সে রক্ষা করত, আক্রান্ত যে কোনও মানুষকে সে রক্ষা করত, না করলে সেটাই হত এক হিংস্র আচরণ। বলে যে, এমনকী, শেঠ যদি ওই যুবকদের প্রতি-আক্রমণ করত, তা হলে সে বাঁচাত তাদেরও। অর্থাৎ, দল নয়, ধর্ম নয়, সম্প্রদায় নয়, আক্রান্ত মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয়, সে আক্রান্ত। আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে এই বোধটুকু সম্বল করেই।
আক্রান্ত মুসলমান বা হিন্দুর পাশে দাঁড়াতে গেলে, তাই, চিৎকার করে কি আমাদের বলতেই হবে যে ওকে যদি মারো, তা হলে আমাকেও মারো, কারণ আমিও হিন্দু বা মুসলমান? এই ঘোষণার নাটকীয়তায় হয়তো তাৎক্ষণিক কিছু লাভও হতে পারে। হয়তো আক্রমণকারীকে অপ্রস্তুত করে দিয়ে সাময়িক ভাবে রক্ষাও করা যেতে পারে আক্রান্তকে। কিন্তু, এতে আবারও সেই চিরপুরাতন ‘আমরা/ওরা’-র অন্ধকূপেই আমরা শেষমেশ বন্দি হয়ে পড়ব না তো? তালিকার বিরুদ্ধে যাঁরা পাল্টা তালিকা পেশ করেন, তাঁদেরই হাত শক্ত করব না তো? সত্যি কথা বলতে কী, এই ধরনের ঘোষণা যখন, মাঝে মাঝে, অনুভূতিপ্রবণ শিল্পী-কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের করতে দেখি, তখন ভয় লাগে। প্রশ্ন জাগে, আবেগ-অশ্বটির লাগাম কষে ধরে তাঁরা এই কথা বলছেন তো? বলছেন তো একটু গভীর ভাবে ভেবে, তলিয়ে সব দিক দেখে?
প্রশ্নগুলো আসছে, কারণ আমরা তো জেনেছি (মনে হয়, মেনেওছি) যে, আমাদের পরিচয় একটি নয়, একাধিক। সংকটের মুহূর্তে যে কবি, শিল্পী বা বুদ্ধিজীবী বলছেন, গর্ব করে বলছি আমি হিন্দু বা মুসলমান, কিন্তু আমি উদার, আমি অন্য ধর্মকে শ্রদ্ধা করি, তিনি কি মনে রাখছেন, তিনি কেবল হিন্দু বা মুসলমান নন, তিনি এক জন কবি বা শিল্পী, হয়তো বা ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগান ক্লাবের, কিংবা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা মান্না দে-র গানের সমর্থক এবং এই সব ক’টি খণ্ড খণ্ড অস্তিত্বই নির্মাণ করেছে তাঁর পরিচিতি? মনে কি রাখছেন যে, তাঁর এই বহুপরিচিতির মধ্যে থেকে তিনি বিপজ্জনক ভাবে বেছে নিচ্ছেন মাত্র একটিকেই? ঠিক, এ কথা বলা যেতে পারে যে, পরিস্থিতি তাঁকে বাধ্য করছে এমনটা করতে, তিনি নিজে চাইলেও জগৎ তাঁর ওই বহুপরিচিতিকে দেখতে চায় না, দেখাতেও চায় না, বরং তাঁকে একক-পরিচিতির একটি কফিনের মধ্যে পুরে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চায়। সাধারণ মানুষ হলে এ যুক্তি খাটে। কিন্তু, কবি-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের বেলায়? তাঁরা আর একটু তলিয়ে ভাববেন না, যখন অমর্ত্য সেন-এর মতো মানুষ বারবার আমাদের একক-পরিচিতির বিপদ সম্বন্ধে সচেতন করেছেন?
আমি উদার হিন্দু, তাই আক্রান্ত হিন্দুর পাশাপাশি আমি আক্রান্ত মুসলমানের পাশেও দাঁড়াচ্ছি। আমি উদার মুসলমান, তাই আমি আক্রান্ত মুসলমানের পাশাপাশি আক্রান্ত হিন্দুর পাশেও দাঁড়াচ্ছি। শুনছি এই সব কথা, আর মনে হচ্ছে, এই ভাবে ভাবলে কোথাও একটা ভুল হয়ে যাবে। যিনি প্রকৃতই উদার, একক-পরিচিতির ছোট্ট কফিনে তিনি নিজেকে বন্দি করবেন কেন?