মতের অমিল হলেই ‘সংঘী’ বলে দেগে দিলে হবে না

কথাটা কিন্তু অনেকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে

আমি যখন এই লেখা লিখছি তখন উত্তরপ্রদেশের মসনদে যোগী আদিত্যনাথ। যোগী। শব্দটা গোলমেলে। তিতিক্ষা আর ত্যাগের যে অনুষঙ্গ এই শব্দটি বয়ে নিয়ে আসে, যে ধীমান পুরুষকে কল্পনায় অবয়ব দেওয়ার চেষ্টা করি, তাঁর সঙ্গে এই মানুষটিকে মেলানো দুষ্কর।

Advertisement

সুমিত চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০১৭ ০০:০১
Share:

দ্রুত: জেএনইউ-এর ঘটনাবলির প্রেক্ষিতে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের বিক্ষোভ মিছিল। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, ২ মার্চ ২০১৭। পিটিআই

আমি যখন এই লেখা লিখছি তখন উত্তরপ্রদেশের মসনদে যোগী আদিত্যনাথ। যোগী। শব্দটা গোলমেলে। তিতিক্ষা আর ত্যাগের যে অনুষঙ্গ এই শব্দটি বয়ে নিয়ে আসে, যে ধীমান পুরুষকে কল্পনায় অবয়ব দেওয়ার চেষ্টা করি, তাঁর সঙ্গে এই মানুষটিকে মেলানো দুষ্কর। তা হলে এই জনসমর্থনকে কী ভাবে বিচার করব? মেনে নেব যে অসূয়া আর সহজ বিভাজনের এই ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতিই ভারতবর্ষের প্রকৃত চিত্র? ভোটাভুটি আর গণতন্ত্রের যে বিপুল বিস্তার স্বাধীন ভারতবর্ষের বিজ্ঞাপন, তার প্রতি কি আস্থা হারাব? না কি এক ধরনের শহুরে, ঝকঝকে, আত্মকেন্দ্রিক, মেধার গন্ধ লাগা, আপাতজটিল অন্য এক বিভাজনের চাল দিয়ে আমাদের দায় ঝেড়ে ফেলব?

Advertisement

এটা সন্দেহাতীত যে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উঠে আসা রাজনীতি কিম্বা তার ধরন বা ভাষ্য একটা জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পরিসর তৈরি করে। সংবাদপত্র, টেলিভিশন, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়ে অনেক দূর। আমাদের দেশের বেশ কিছু নামী বিশ্ববিদ্যালয় মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তির খনি। বহু বছর যাবৎ তারা একাধারে বুদ্ধিজীবী আর অন্য দিকে রাজনৈতিক নেতা তৈরি করে এসেছে। তাঁদের কথা শুনতে এবং তাঁদের মতামতকে প্রশ্রয় দিতে অন্তত এক শ্রেণির মানুষ প্রস্তুত।

সাম্প্রতিক কালে জেএনইউতে ঘটে যাওয়া এক প্রায়-বিপ্লবের ঘটনা আমরা জানি। কানহাইয়া-উমর-অনির্বাণদের ঘিরে সেই বিপ্লবের সমারোহ। রাষ্ট্রের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো তরুণ প্রজন্ম। ব্যক্তির মর্যাদা, এক জন প্রান্তিক মানুষের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিঃস্বার্থ আওয়াজ তোলা। এই মহৎ অগ্ন্যুৎপাত স্বদেশের মানুষের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের নির্দেশ। প্রশ্ন অন্য জায়গায়। এই মহতী আগুন তার দিশা পেল কি? দেশের আম নাগরিক কি বুঝতে পারলেন উমর কানহাইয়ারা ঠিক কী দাবি করছেন? কোন স্বাতন্ত্রের কথা বলছেন? কী তাঁদের যুক্তি অপশাসকের বিরুদ্ধে? আমরা দেখলাম এমন আন্দোলন যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় নিজেই প্রায় একটা রাষ্ট্রের দাবি রাখে। ওরা-আমরা সহজ বিভাজনে যেখানে ছাত্ররাই সোশ্যাল মিডিয়াতে গর্জে ওঠে: আমি অ্যান্টি-ন্যাশনাল, সংঘী নই। আপাতদৃষ্টিতে অতিসরল দ্বিমাত্রিক যুক্তি। ওকে দাগিয়ে দিলাম, সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকেও দাগিয়ে নিলাম: আমি বামপন্থী লিবারেল, আমি তাত্ত্বিক, ধর্ম আমার কাছে বিষের সমার্থক। কিন্তু এই ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ তকমার বিপ্লবমণ্ডিত দীপ্তি কি তার লক্ষ্যে পৌঁছল? না কি তা সীমিত রইল চেনা গণ্ডির নিশ্চিন্ত প্রশ্রয়ে?

Advertisement

দুঃখের কথা, ঠিক এই যুক্তিরই সন্ধানে ছিলেন বিরোধী পক্ষ। তাঁরা বেশির ভাগই ছাত্র নন, একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সেবক, রাজনীতি তাঁদের পেশা। তাঁরা নেমে পড়লেন রাস্তায়, যে রাস্তার পরিসর একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের থেকে অনেক অনেক বড়। আমজনতার কাছে অনেক সহজে পৌঁছে গেলেন তাঁরা, কারণ তাঁদের ভাষা, তাঁদের যুক্তির ধরন অনেক সহজিয়া। তাঁরা বোঝালেন কী ভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে, যা কিনা সাধারণ নাগরিকের কষ্টার্জিত পয়সায় চলে, বাসা বেঁধে দেশদ্রোহীরা এক জন ফাঁসির আসামি, মুসলিম উগ্রপন্থীর মুক্তির দাবিতে অশান্তি করছে। কাদের বোঝালেন এই যুক্তি? চাওয়ালা, ফলওয়ালা থেকে শুরু করে মুদির দোকানি, কনিষ্ঠ কেরানি থেকে জাঁদরেল অফিসার, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার ব্যাঙ্ককর্মী, কেউ বাদ নেই। প্রতিযুক্তি দিলেন পরিশীলিত ছাত্র ও শিক্ষকরা। দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরের ভিতর। ছড়িয়ে দিলেন সেই সব যুক্তি সোশ্যাল মিডিয়ায়, ইউটিউবে, খবরের কাগজের সম্পাদকীয় পাতায়। ‘নেশন’ কী? তার ধারণা এল কোত্থেকে? কে সন্ত্রাসবাদী, কে নন? সুমহান ঐতিহ্যের কান্ডারি এই ভারতবর্ষে নেশন-স্টেট বলতে আমরা কী বুঝি!

মুশকিল হল দুটো। প্রথমত, ওই যে আমজনতা, যাদের প্রথম পক্ষ বুঝিয়েছিলেন যে অপর পক্ষ আদতে অ্যান্টি-ন্যাশনাল, সেই আমজনতা কিন্তু রাজনীতিকে একটা সরল সমীকরণ রূপেই দেখেন, কারণ তাঁদের বেশির ভাগই বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন বা পার্থ চ্যাটার্জি পড়েননি, পড়বার প্রয়োজনও বোধ করেননি। দ্বিতীয়ত, নেশনহুড সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল বুদ্ধিজীবীরও একটাই ভোট, আর বাকি জনতারও একটাই ভোট। আদতে ওই ঘটনার যে প্রবাহ, এবং তার থেকে জন্ম নেওয়া যে সরল মেরুকরণ, তাতে কিন্তু লাভের লাভ বিজেপির ঘরেই বেশি গেল।

আমি মোটেই এ কথা বলতে চাইছি না যে বিজেপির এই পরাক্রমী উত্থানের কারণ ওই ঘটনা, বা তার পরবর্তী কালে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া আরও কিছু ইতস্তত ঘটনা, যা বিভিন্ন সময় আমাদের বিচলিত করেছে। ওই ঘটনার পর বিহারে ভোট হয়েছে, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি সেখানে বিশেষ এঁটে উঠতে পারেনি। কিন্তু এ কথা বোধহয় স্বীকার করবার সময় এসেছে যে উত্তরপ্রদেশের বিজয়নিশানে এই লেফট-লিবারেল ধাঁচার বৌদ্ধিক গোঁড়ামি এবং অহংয়ের দাগ লেগে রয়েছে। হাজার-হাজার মানুষের ভোটেই কিন্তু আদিত্যযোগী আজ মসনদে, এ কথা মেনে না নিয়ে পালাবার পথ নেই। আর এই ভোটারকুল কিন্তু আমাদের ঘরে-ঘরে রয়েছেন। উপরের পালিশটা অল্প চটিয়ে দিলেই অসহিষ্ণুতা আর ঘৃণার দাঁত-নখ বেরিয়ে পড়বে। জটিল তত্ত্বের বুলি কপচে তাঁদের অবজ্ঞা করলে কাজের কাজ কিছু হওয়ার সম্ভবনা কমই। আর মতের অমিল হলেই সোশ্যাল মিডিয়াতে কাউকে ‘সংঘী’ বা ‘হনুমান’ বা ‘চাড্ডি’ বলে দেগে দিলেই দায় শেষ হয় না বোধকরি। সহজ কথা সহজ করে বলবার সময় এখন। ‘ইচ ওয়ান টিচ ওয়ান’-এর ধাঁচে, এক এক জনকে এক এক জনের দায়িত্ব নিতে হবে। এখনও বুঝি ভারতের আধুনিকতার ধারা সেই জায়গায় পৌঁছয়নি যেখানে আমরা এক জন মানুষের অধিকার বা স্বাতন্ত্র্য নিয়ে জনমানসে বিন্যাসিত একটা যুক্তি খাড়া করতে পারি। আলোচনা করতে পারি ব্যক্তিমানুষের উপর রাষ্ট্রের কতখানি অধিকার সম্ভব, বা আদৌ কোনও অধিকার আছে কি নেই! দুঃখের কথা, এই আলোচনা এখনও আমাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, আলোচনাসভা, কিম্বা ক্লাসরুমের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। বাইরের রাজনীতিতে একটা সরল মেরুকরণ রয়েছে, এইটা মেনে নিয়েই আপাতত যুক্তিজাল বিস্তার করতে হবে হয়তো। স্বাধিকারের প্রশ্ন বা নেশন-স্টেট নিয়ে যে সব জটিল সন্দর্ভ আমাদের কাছে ভীষণ জরুরি, তা যে অপরের কাছে আপাতত গুরুত্ত্বহীন হতেও পারে সে কথা এড়িয়ে গেলে মুশকিল। সেই জায়গায় অনায়াসে ঢুকে পড়বে বিভাজনের ব্যবসায়ী। বরং আলোচনার জমি সহিষ্ণু হয়ে তৈরি করা প্রয়োজন। বিভাজনের প্রতিযুক্তি যতই জটিল হোক না কেন, তাকে সহজ ভাবে, অনেকের মতো করে বলতে পারাই হয়তো আমাদের পথ দেখাবে।

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন