মা-বাবাদের উচ্চাশাই দায়ী?

প্রথম ও তৃতীয় খবরের মধ্যে যোগসূত্র অনেক বুদ্ধিজীবী, মনোবিদ, শিক্ষক ও অভিভাবক খুঁজে বার করে ফেলেছেন। এই শেষ দুর্ঘটনার আগে থেকেই নানা আলোচনাচক্রে মা-বাবার উচ্চাশা ও তার চাপে অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের মানসিক অবসাদের কথা আলোচিত হচ্ছে। তা হলে কেন উচ্চাশা কমছে না?

Advertisement

অনিন্দিতা সেন

শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৯ ০০:১০
Share:

গত এক মাসে খবরের কাগজের প্রথম পাতায় কয়েকটি খবর আর বিজ্ঞাপন চোখে পড়েছে। সেগুলোর মধ্যে একটা যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করা যাক। এক, এই বছর আইএসসি-তে যে প্রথম হয়েছে, সে পেয়েছে পুরো ১০০ শতাংশ নম্বর। দুই, প্রতি বছরের মতো এ বছরও আইআইটি, জয়েন্ট এন্ট্রান্সের ফল প্রকাশের পর কাগজে পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে, সফল ছাত্রছাত্রীদের হাসিমুখ ছবি সমেত। তিন, এক নামী বেসরকারি স্কুলের এক মেধাবী ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে।

Advertisement

প্রথম ও তৃতীয় খবরের মধ্যে যোগসূত্র অনেক বুদ্ধিজীবী, মনোবিদ, শিক্ষক ও অভিভাবক খুঁজে বার করে ফেলেছেন। এই শেষ দুর্ঘটনার আগে থেকেই নানা আলোচনাচক্রে মা-বাবার উচ্চাশা ও তার চাপে অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের মানসিক অবসাদের কথা আলোচিত হচ্ছে। তা হলে কেন উচ্চাশা কমছে না? এখনকার মা-বাবারা কি অত্যধিক লোভী? না কি তাঁরা নিজের সন্তান এর হিতাকাঙ্ক্ষী নন?

মা-বাবার ‘উচ্চাশা’র উৎসটা ঠিক কোথায়? তার শুরু কবে থেকে? এবং, তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, সেটা যে উচ্চাশাই, আমরা নিশ্চিত জানি? সেই ‘উচ্চাশা’র সঙ্গে সফল ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে পাতাজোড়া বিজ্ঞাপনের যোগসূত্র কি নিবিড় নয়? আমার মনে হয়, সন্তানের হিতাহিত যে আসলে কিসে, এই বিজ্ঞাপনের বাজারে বহু মা-বাবাই তা ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। তাই ছোটবেলায় তাকে নানা রকম হেলথ ড্রিঙ্ক খাওয়ান। কিছুটা বড় হলে যেই দেখেন সন্তান পিছিয়ে পড়ছে, গৃহশিক্ষক নিয়োগ করেন। বোর্ডের পরীক্ষার আগে বড় কোচিং সেন্টারে পাঠান। এটাকে কি সত্যি সত্যি উচ্চাশা বলা উচিত? না কি আত্মবিশ্বাসের অভাব? এক রকমের বিভ্রান্তি?

Advertisement

প্রায়ই শুনি, লেখপড়া সংক্রান্ত কথোপকথন শুরু হচ্ছে ‘আজকাল প্রতিযোগিতার বাজারে...’ বলে। কেউ অস্বীকার করবেন না, ত্রিশ বছর আগে আমাদের দেশে চাকরির যত সুযোগ ছিল, এখন সুযোগ তার চেয়ে ঢের বেশি। তা হলে, কিসের প্রতিযোগিতা বাড়ল? নম্বরের? সেটা কিন্তু একেবারেই মনগড়া নয়। ইদানীং পরীক্ষায় মুড়িমুড়কির মতো নম্বর ওঠে, সেটুকু গোটা সমাজই খেয়াল করে। কিন্তু, পরীক্ষার ধাঁচ যে পাল্টে গিয়েছে অনেকখানি, সেটা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছাড়া জানা মুশকিল। বাস্তব হল, এখন স্কুলস্তরের পরীক্ষায় বিশ্লেষণাত্মক প্রশ্নের চেয়ে অনেক বেশি আসে তথ্যভিত্তিক প্রশ্ন। তাতে নম্বর ওঠে ছাঁকা, কিন্তু মুখস্থ করতে হয় প্রচুর। ফলে, গোড়া থেকে সে চাপ থাকে ছাত্রছাত্রীদের ওপর। মা-বাবাদের ওপরও।

সেটা শুধু উচ্চাকাঙ্ক্ষার চাপ বললে অনেক অভিভাবকের প্রতিই অন্যায় হবে। বোর্ডের পরীক্ষায় ঝুলিভর্তি নম্বর নিয়ে ফিরতে হবে, সন্তানের কাছে এমন দাবি যদি তাঁরা করেনও, সেটা উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকে যতখানি, তার চেয়ে বেশি অনিশ্চয়তা থেকে। হরেক স্কুলের বিজ্ঞাপন অভিভাবকদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়— ‘এই বছর আমাদের স্কুল থেকে এত জন ছাত্র ৯০%-র ওপর পেয়েছে।’ মা-বাবা দিশেহারা। সত্যিই যদি সবাই ৯০% পায়, তা হলে আমার সন্তান ৮৫% পেলে তো কোথাও ভর্তি হতে পারবে না। দুশ্চিন্তাটা অমূলকও নয়। অর্থাৎ, যেটাকে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে মা-বাবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা, তার মূলে রয়েছে দুশ্চিন্তা, নিরাপত্তাবোধের অভাব।

বাজার তো এই নিয়ম মেনেই চলে— প্রথমে একটা অনিশ্চয়তা তৈরি করা, আর তার পর সেই অনিশ্চয়তা থেকে, অভাব থেকে, মুক্তি পাওয়ার পথ বাতলে দেওয়া। অবশ্যই, নগদের বিনিময়ে। শিক্ষার বাজারও চলছে এই ভাবেই। ‘অস্বাভাবিক’ সাফল্যের উদ্‌যাপনের ছবির পাশেই একটা অপ্রকাশ্য ছবিও থাকে— অগণিত ব্যর্থতার ছবি। আশঙ্কিত অভিভাবকরা ঠিক দেখতে পান সেই না-ছাপা ছবিটা, আর তাতে নিজের সন্তানের মুখ চোখে পড়ে। সেই ব্যর্থতাকে এড়াতে তাঁরা বাজারের এগিয়ে দেওয়া সমাধানকে আঁকড়ে ধরতে চান। এই কারণেই লেখার গোড়ায় কাগজের প্রথম পাতায় পাতাজোড়া বিজ্ঞাপনের কথা তুলেছিলাম। সে বিজ্ঞাপন তো আর সফল ছাত্রছাত্রীদের অভিনন্দন জানানোর জন্য নয়, ওটা নিজেদের বিজ্ঞাপন। সন্তানের ‘সাফল্য’-এর পথ খুঁজতে দিশেহারা মা-বাবাকে ধরে ফেলার বিজ্ঞাপন। ছবিতে উদ্ভাসিত মুখের কৃতী ছেলেমেয়েগুলো আসলে এই ব্যবসার মূলধন। শিক্ষা-শিল্পের শিশুশ্রমিক। স্কুলগুলোও এখন এ ভাবেই ব্যবহার করে কৃতী ছেলেমেয়েদের। বিভ্রান্ত, অনিশ্চিত অভিভাবকদের দিয়ে নিজেদের পণ্য কিনিয়ে নিতে। হেলথ ড্রিঙ্কের বিজ্ঞাপনের স্বাস্থ্যবান শিশুটি যেমন অভিভাবকদের মনে নিজের শিশুর স্বাস্থ্য সম্বন্ধে ভয় ধরিয়ে দেয়, এবং বাধ্য করে সেই হেলথ ড্রিঙ্কটি কিনতে, যা খেয়ে তাঁদের সন্তানও আরও লম্বা, আরও শক্তিশালী, আরও বুদ্ধিমান হয়ে উঠবে— স্কুল আর কোচিং ক্লাসের বিজ্ঞাপনও ঠিক সেই কাজটাই করে চলেছে নিরন্তর।

কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিং-বিরোধী আইন খুব কড়া ভাবে জারি হওয়ার পর কিন্তু আত্মহত্যার হার অনেকখানি কমে গিয়েছে। স্পষ্টতই, র‌্যাগিংয়ের শিকার হচ্ছে যে ছেলেটি বা মেয়েটি, শুধু তার কাউন্সেলিং করে সমস্যার সমাধান হয় না— র‌্যাগিং বন্ধ করার ব্যবস্থা করতে হয়। কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের সুরক্ষার জন্যও আইন আছে। তা হলে, স্কুলের ছেলেমেয়েদের এই মারাত্মক চাপ থেকে বাঁচানোর জন্য কোনও আইন থাকতে পারে না? তারা তো আরও কত ছোট! তাদের মানসিক সুরক্ষার দাবি নিয়ে এই সমাজ মাথা ঘামাবে কবে?

বর্তমানে এ রকম দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটলে দায়টা গিয়ে পড়ছে ভুক্তভোগী ছাত্রছাত্রী, তাদের মা-বাবা ও স্কুলের ওপর। আমরা কি শুধু মা-বাবার উচ্চাশা আর ছেলেমেয়েদের মনের জোরের অভাবের কথা বলে দায়িত্ব সারতে পারি? এই দায় কি সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা বা গোটা সামাজের নয়? আর কত প্রাণের মূল্যে সে কথা ভাবব?

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন