সত্যিই আমার নামে নয় কি?

মজার কথা, যে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা নিজেদের আত্মপরিচয় বা আত্মরক্ষার জন্য এই আন্দোলন শুরু করেছিলেন প্রবাসের মাটিতে, মূলত সেই ধর্মাবলম্বীদের রক্ষার্থে বা সমর্থনে শুরু হল এই আন্দোলন আমাদের দেশের মাটিতে।

Advertisement

ঈশা দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০১৭ ০০:০০
Share:

জানলাম, আন্দোলনের নাম— ‘আমার নামে নয়’। এও জানলাম, আন্দোলনের বিষয়বস্তু কী। এর উৎপত্তি সত্তরের দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী প্রতিবাদের সময় হলেও, সাম্প্রতিক কালে এর ব্যবহার হয়েছে বিলেতের মাটিতে, মুসলিম জঙ্গি হানাকে কেন্দ্র করে। ইসলাম ধর্মাবলম্বী জঙ্গিদের সঙ্গে যাতে সে দেশে বসবাসকারী অন্য মুসলিম মানুষকে এক ব্র্যাকেটে না ফেলা হয়, কালিমালিপ্ত না করা হয়, তাই বলা — ‘নট ইন মাই নেম’ বা ‘আমার নামে নয়’। সোজা কথায়, আমাকে ওদের সঙ্গে এক কোরো না। আমার ধর্ম এক হতে পারে, কিন্তু আমি ওদের মতো নই। ২২ জুনের ভারতবর্ষে ঘটা আর একটি ‘হেট ক্রাইম’ বা ঘৃণাতাড়িত অপরাধের ঘটনাকে কেন্দ্র করে একই আন্দোলন, একই নাম নিয়ে শুরু হয় ২৩ জুন। শুরু হয় আন্তর্জাল-ভিত্তিক সামাজিক জনমাধ্যমের ওপর ভর করে, যাকে আমরা সোশ্যাল মিডিয়া বলে ডাকি। সেই আন্দোলন সংগঠিত হয়ে আন্তর্জালের বাইরে তার মুখ দেখায় ২৬ জুন, আমরা খবরের কাগজে তার ছবি দেখি। অনেক পরিচিত, সম্মানিত বুদ্ধিজীবীদের মুখ আন্দোলনের ওজন বাড়ায়—দিল্লি, কলকাতা, মুম্বই, বেঙ্গালুরুতে। অরাজনৈতিক সমষ্টিগত নাগরিক প্রতিবাদ এত ব্যাপক ভাবে ঘটল সম্ভবত নির্ভয়া-কাণ্ডের পরে এই প্রথম। দেশের বাইরে, বস্টন টরন্টো নিউ ইয়র্কে ছড়িয়ে পড়েছে এর শাখাপ্রশাখা। সেও কম কথা নয়।

Advertisement

মজার কথা, যে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা নিজেদের আত্মপরিচয় বা আত্মরক্ষার জন্য এই আন্দোলন শুরু করেছিলেন প্রবাসের মাটিতে, মূলত সেই ধর্মাবলম্বীদের রক্ষার্থে বা সমর্থনে শুরু হল এই আন্দোলন আমাদের দেশের মাটিতে। লক্ষণীয় যে, এ ক্ষেত্রে, আন্দোলনের মূল হোতা কিন্তু আবশ্যিক ভাবে ইসলাম ধর্মাবলম্বী নন। এবং, এই আন্দোলনের মূল মুখ বা শরীরও প্রধানত ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বীদের দ্বারাই গঠিত। তাই, আন্দোলনের স্লোগান এক থাকলেও, ভারতে এই প্রতিবাদের গুরুত্ব নিশ্চিত ভাবেই বৃহত্তর। হাজারে হাজারে অ-মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ, মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রীয় ক্ষোভ বা সন্ত্রাসের তোয়াক্কা না করে প্রতিবাদে শামিল হচ্ছেন, এও বড় কম কথা নয়। বিশেষত এই অসহিষ্ণু সময়ে, যখন শুধু মুসলিম-হিন্দু বিভাজন নয়, বর্ণহিন্দু–অন্ত্যজ ধর্মীয় হিংসাও চূড়ান্ত নৃশংসতার রূপ নিচ্ছে। সেই হিংসার প্রতিবাদে উত্তরপ্রদেশে সাহারানপুর জেলায় ১৮০টি অন্ত্যজ হিন্দু পরিবারের বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করার ঘটনাও মাত্র এক মাস পুরনো। এও মনে রাখতে হবে, ইসলাম ধর্মাবলম্বী কিশোর জুনায়েদের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ‘নট ইন মাই নেম’ আন্দোলনের হোতা সবা দেওয়ান, তিনি ধর্মে হিন্দু, উর্দু লেখক বেরিন্দ্রনাথ দেওয়ানের কন্যা।

এই অবধি জেনে বা পড়ে আমরা উদ্বেলিত হই। এমন তো নয়, যে, ২২ জুন ঘটা কিশোর জুনায়েদের হত্যাকাণ্ড এই অসহিষ্ণু সময়ে ধর্মীয় হিংসায় ঘটা প্রথম মৃত্যু। খোদ আমাদের পশ্চিমবঙ্গে ঘটে গেছে এর চেয়েও নারকীয় ঘটনা। গত ২৪ জুন উত্তর দিনাজপুরে নাসিরুল হক, মহম্মদ সামিরুদ্দিন এবং মহম্মদ নাসির নামের তিন গ্রামবাসীকে গরু চুরি করার চেষ্টার অপবাদে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়। শুধু গোমাংস ভক্ষণ বা তথাকথিত গোরক্ষাকে কেন্দ্র করে ঘটা তাণ্ডবের সংখ্যা নয় বাদ রাখলাম। রাজস্থানের পেহলু খান, অসমের আবু হানিফা এবং রিয়াজুদ্দিন আলি, মহারাষ্ট্রের মালেগাঁওতে তিন মুসলিম গ্রামবাসী— এমন বহু মানুষ শিকার হয়েছেন। তা হলে আমরা এক্ষুনি উদ্বেলিত হলাম কেন? সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব? ব্যান্ডওয়াগন এফেক্ট? যেখানে প্রতিবাদে অংশ নিলে সংঘবদ্ধ থাকার নিরাপত্তা পাওয়া যায়? না কি সত্যি সত্যিই জমেছিল ক্ষোভ? তাই উপযুক্ত মঞ্চ বা প্ল্যাটফর্ম পেয়ে, হাত ধরার মতো হাত পেয়ে মিছিলে হাঁটতে দ্বিধা বোধ করেননি অসংখ্য সাধারণ মানুষ? পরিচিত বুদ্ধিজীবীদের সামনে থাকা নিশ্চয়ই সাহস জুগিয়েছে, কিন্তু তাতে দোষের কী আছে?

Advertisement

শুধু একটাই প্রশ্ন থেকে যায়। যখন বলি, আমার নামে নয়, বা যখন সবার সামনে উচ্চারণ করি, আমার নামে নয়, তখন কি মনে রাখি, আমি কে? আমি এক জন সাধারণ মধ্যবিত্ত গৃহবধূ। বা, আমি এক জন সাধারণ মধ্যবিত্ত সংসারী গৃহকর্তা। ‘মধ্যবিত্ত’, বা ‘গৃহবধূ’, বা ‘গৃহকর্তা’, বা ‘সাধারণ’ — এগুলো উল্লেখ করা এই কারণে যে, আমার আর্থিক, সামাজিক, ধর্মীয়, কোনও অবস্থানেই আলাদা করে বলার মতো কিছু নেই। হ্যাঁ, আমি ঘটনাচক্রে হিন্দু ধর্মাবলম্বী। ঘটনাচক্রে, অর্থাৎ জন্মসূত্রে। সেই হিন্দু আমি যখন প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নিয়ে বলি: ‘আমার নামে নয়’, তখন কি আমি সত্যিই বুঝে বলি, আমি ঠিক কী বলছি?

এইটুকু বুঝে বলি, আমি জুনায়েদের হত্যাকারীকে সমর্থন করি না। হয়তো এটুকুও বুঝে বলি, গরুর মাংস খাওয়াকে কেন্দ্র করে এত বাড়াবাড়ি করার কোনও মানে হয় না। কিন্তু এই সাধারণ হিন্দু মধ্যবিত্ত আমি কি অস্বীকার করতে পারি, আমাদের শহরেরই কোনও কোনও সংখ্যালঘু-প্রধান জায়গা দিয়ে যাওয়ার সময় আমরা কিছু বিরূপ মন্তব্য না-করে থাকতে পারি না? ইদে বিরিয়ানি খাই ঠিকই, কিন্তু দুর্গাপুজোয় আবাসনের ইসলাম ধর্মাবলম্বী গৃহবধূটি এলে মুখে হাসি রেখেই পুজোর বাসন কয়েক ইঞ্চি সরিয়ে নিই? ছেলে বা মেয়ের অন্য ধর্মাবলম্বী বন্ধুটিকে উদারতা দেখিয়ে বাড়িতে ডাকি অবশ্যই, কিন্তু ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের দিনে নয়? সিনেমা হলে বা শপিং কমপ্লেক্সে কিছু ফেজ টুপি বা বোরখাকে একসঙ্গে দেখলে ছেলে বা মেয়ের হাত ধরে একপাশে যাই?

তাই, সবার সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলতেই পারি, বিশেষ করে তা বললে যখন ফেসবুকের তাৎক্ষণিক হাততালি জুটে যাচ্ছে প্রচুর, যে, আমার নামে নয়। কিন্তু সত্যিই আমার নামে নয় কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন