দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্বের শিক্ষক

বরং নিজেকে নিয়ে বাঁচতে শিখি

বড় পরিবার ভেঙে অণু হয়েছে, সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েরাও অধিকাংশই কর্মসূত্রে, অথবা বিবাহসূত্রে দেশ বা শহর ছেড়েছে, পাড়া কালচার প্রায় হারিয়ে গিয়েছে, পড়শিরা বিচ্ছিন্ন, একা। সবই ঠিক।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৬:০০
Share:

মু ‌ম্বইয়ের লোখন্ডওয়ালায় বহুতল থেকে যে ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধার কংকাল পাওয়া গিয়েছিল দিনকয়েক আগে, তিনি বৃদ্ধাবাসে চলে যেতে চেয়েছিলেন। পারেননি। পরিণতি মর্মান্তিক। বদ্ধ ফ্ল্যাটের একলা জীবন কখন যেন কঙ্কাল হয়ে গিয়েছিল। ব্যস্ত পৃথিবীর নাকে পচা গন্ধটুকুও আসেনি।

Advertisement

এই-ই কি তবে আমাদের দেশের বয়স্কদের ভবিতব্য? বয়স যখন গুটি গুটি শেষ পর্বে, সন্তান যখন হাত ছাড়িয়ে অনেক দূরে, তখন একটা একলা বারান্দা আর অ্যালবামের পাতা নিয়ে বেঁচে থাকা?

বড় পরিবার ভেঙে অণু হয়েছে, সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েরাও অধিকাংশই কর্মসূত্রে, অথবা বিবাহসূত্রে দেশ বা শহর ছেড়েছে, পাড়া কালচার প্রায় হারিয়ে গিয়েছে, পড়শিরা বিচ্ছিন্ন, একা। সবই ঠিক। কিন্তু এর বাইরেও একটা কারণ আছে। এখন যাঁরা ষাট, সত্তর, আশি, এই মানুষগুলো, সবাই না হলেও, অনেকেই, নিজের জন্য বাঁচতে শেখেননি। তাঁদের শিখতে দেওয়া হয়নি। ফেলে আসা বছরগুলো তাঁরা কাটিয়ে এসেছেন শুধুই পাহাড়প্রমাণ দায়িত্বের বোঝা বয়ে। জানলা দিয়ে দু’মিনিট পৃথিবীটার দিকে তাকানোর ফুরসত হয়নি। অল্প বয়সে বিয়ে, সন্তান, সংসার নিয়ে ভরপুর জীবন। কোনও খুঁত নেই। স্বামী অর্থ উপার্জনের খোঁজে ব্যস্ত আর স্ত্রী সংসার সামলাতে। বউ চাকরি করলে, সেটা আর এক বাড়তি দায়িত্ব। চাকরির অজুহাতে অন্য কর্তব্যে ফাঁকি মঞ্জুর হত না মোটেই। ‘গার্লস গ্যাং’, বন্ধুমহলে আড্ডা, সপ্তাহান্তে বেড়াতে যাওয়া, কিচ্ছু ছিল না সেখানে। স্বামী-স্ত্রী’র বেড়াতে যাওয়াও তখন নেহাত নিয়মরক্ষে। তাতে মুক্তির স্বাদ যত না, দায়িত্বের বোঝাই বেশি। সফরসঙ্গীদের স্বাচ্ছন্দ্যে যাতে ফাঁক না পড়ে, সেই দায়িত্ব।

Advertisement

এই বিবর্ণ জীবনের একমাত্র সান্ত্বনা পুরস্কার ছিল সন্তান। বিশেষত মায়েদের ক্ষেত্রে। তাদের দুষ্টুমি, সাফল্য, তরতরিয়ে বেড়ে ওঠার মধ্যেই সে কালের মেয়েরা নিজেদের আটকে ফেলেছিল। ঠিক যেন সুচিত্রা ভট্টাচার্যের ‘ইচ্ছের গাছ’-এর মায়ের চরিত্র। একমাত্র সন্তানকে ঘিরেই বেঁচে থাকা-হাসি-কান্না-রাগ-ক্ষোভ। সন্তানের পনেরো-ষোলো বছর অবধি সে জীবন টাল খায় না। খায় তখনই, যখন সেই সন্তানই দূরত্ব বাড়ায়। মায়ের বৃত্ত থেকে তখন তার বেরিয়ে আসার সময়, নতুন দুনিয়ায় পা রাখার সময়, আর পালটা প্রশ্ন করার সময়— ‘আমার ব্যাপারে কথা বলার তুমি কে?’

অধিকাংশ মায়ের একাকিত্বের এটাই শুরু। ক্ষেত্রবিশেষে বাবাদেরও। সন্তানের পিছনে উদয়াস্ত দৌড়োদৌড়ি, পরীক্ষার সময় রাত জাগা বা স্কুলের পেরেন্ট-টিচার মিটিংয়ের দিনগুলোর শেষে হাতে তখন অজস্র সময়। অথচ এত কালের ঘরবন্দি মন নতুন করে কিছু শুরু করতেও বাধা দেয়। ছোটবেলার হারমোনিয়ম তত দিনে ভেঙেচুরে একশা, কোথায় হারিয়ে গিয়েছে কবিতার খাতা, ফোন নম্বর লেখা ডায়রি-ঠাসা শুধুই আত্মীয়স্বজন, এক জনও বন্ধু নেই সেখানে। ফলে, হঠাৎই তৈরি হয় এক বিরাট শূন্যতা। অবসাদ, নিঃসঙ্গতা।

এই নিঃসঙ্গতা কাটানোর ওষুধ একটাই। হাসার, বেঁচে থাকার অন্য রাস্তাগুলো সময় থাকতে খুলে রাখা। মনকে বোঝানো, শুধুই পরিবারকে ঘিরে বাঁচতে চাইলে, সে বাঁচা ক্ষণস্থায়ী। পরিবারের ভালতেই আমার সবটুকু ভাল নয়, পরিবারের আনন্দেই আমার সবটুকু আনন্দ নয়। আমার আনন্দ, আমারই নিজস্ব। পরিবার তার শরিকমাত্র।

ছোটবেলায় পাড়ায় এক মাতাজিকে দেখতাম। বয়স্ক। একাই থাকতেন। সেই অর্থে পরিবার, সংসার কিছুই ছিল না তাঁর। কিন্তু পুষ্যি ছিল অনেক। পাড়ার যত কুকুর এবং তাদের ছানাদের ‘মানুষ’ করার ভার ছিল তাঁর ওপর। তাদের দু’বেলা খাওয়ানো, দেখাশোনা, ছোট্ট ছানাগুলো নর্দমায় পড়ে গেলে তাদের তুলে পরিষ্কার করা, বকেধমকে ডিসিপ্লিন শেখানো, সব দায়িত্বই তাঁর। ভয়ানক ব্যস্ততায় দিন কাটত। ‘একাকিত্ব’ তাঁর ত্রিসীমানায় ঘেঁষার সাহস পেত না। যাঁরা এই ভাবে নিজেদের জগৎটা নতুন করে গড়ে নিতে পেরেছেন, তাঁরা জয়ী।

তখন পাড়ার মন্দির চত্বরে, বাড়ির রকে বা রেল স্টেশনের পাশে যে বয়স্কদের আড্ডা বসত, তাতেও দেখা যেত প্রাণপণে নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা। ওই এক-দেড় ঘণ্টায় হাসিকান্না ভাগ করে নেওয়া, অসুস্থ বন্ধুদের খোঁজখবর করা, তুলনায় ঝিমিয়ে পড়াদের সঙ্গে খুনসুটি করে চাঙ্গা করে তোলা— অর্থাৎ ভাল থাকতে চাওয়া, জীবনের সাঁঝবেলায় পৌঁছে আর একটু অক্সিজেন টেনে নেওয়া। শেষ বয়সে সমমনস্কদের সাহচর্য পেতে অনেকেই এই কারণে এখন বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে চান। স্বেচ্ছায়। লোখন্ডওয়ালার বৃদ্ধাও সেটাই চেয়েছিলেন।

এখন যাঁদের মধ্যবয়স, তাঁদের হয়তো পরবর্তী জীবনে এই সীমাহীন একাকিত্বে ততখানি ভুগতে হবে না। কারণ, ইতিমধ্যে তাঁরা জেনে ফেলেছেন একলা হয়েও সুন্দর বাঁচা যায়। যাঁরা ঘোর সংসারী, তাঁরাও জানেন পরিবার আর বাইরের দুনিয়াটার মধ্যে কী সুন্দর ব্যালান্স করে এগিয়ে চলা যায়। ছেলের স্কুলের অ্যাডমিশন টেস্ট যতখানি জরুরি, ঠিক ততখানিই জরুরি অফিস ট্যুরে সিঙ্গাপুর যাওয়া, রবিবার বাড়িতে বিরিয়ানি রাঁধার পাশাপাশি স্পা থেকে এক বার ঘুরে আসা। তাতে সংসারও ভেসে যায় না, ছেলেমেয়েও দিব্যি মানুষ হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন