সম্পাদকীয় ১

নূতন কীর্তি

ঘরের রাজনীতির হিসাব মিলাইতে বাহিরের কূটনীতির পদক্ষেপ, ইহা একটি পরিচিত অসুখ। ট্রাম্পের জেরুসালেম উল্লম্ফনে সেই অসুখেরই প্রকাশ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share:

ডোনাল্ড ট্রাম্পের আশ্চর্য ক্ষমতা, তিনি এমন কূটনীতির চাল চালিতে পারেন যে শত্রুরা বন্ধু হইবার বদলে বন্ধুরাও শত্রুতা করিবার কথা ভাবিতে শুরু করে। এই মুহূর্তে জেরুসালেম লইয়া তাঁহার আকস্মিক ঘোষণা শুনিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই ঘনিষ্ঠতম দেশ ব্রিটেন ও ফ্রান্স চটপট প্রমাণ করিতে ব্যস্ত যে— তাহারা ট্রাম্পের পাশে নাই। ইজরায়েল ও প্যালেস্টাইনের মধ্যে অন্যতম বিস্ফোরক জেরুসালেম-বিতর্ক বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহল দীর্ঘ কয়েক দশক সতর্কতা অবলম্বন করিয়া আসিয়াছে। আন্তর্জাতিক মহলে ইজরায়েলের অনেক মিত্র দেশ আছে, আমেরিকা অবশ্যই তাহাদের মধ্যে প্রধানতম। কিন্তু সেই মিত্র দেশগুলিও অদ্যাবধি সরাসরি প্যালেস্টাইনের দাবি প্রকাশ্যে নস্যাৎ করিয়া দিবার স্পর্ধা দেখাতে রাজি হয় নাই, অন্তত তত্ত্বগত ভাবে মানিয়া লইয়াছে যে বিষয়টি তত সরল এবং তরল নহে। ইজরায়েলের সামরিক দখল ও প্যালেস্টাইনের নির্যাতনের ইতিহাসের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত লইতে অনেক স্তরের আলোচনা ও পর্যালোচনা দরকার, এবং অবশ্যই মূল দুই পক্ষের অংশগ্রহণ আবশ্যিক। ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে এক দিন সকালবেলা উঠিয়া হঠাৎ করিয়া ইজরায়েলের পক্ষে ভোট দিয়া বিষয়টির সমাধান করিয়া দিবেন, এমন আশঙ্কা কেহই করে নাই। এমনকী পশ্চিম এশিয়ায় মার্কিন মিত্র হিসাবে যে দেশটি পরিচিত, সেই সৌদি আরবও এ বার বাঁকিয়া বসিয়াছে। ট্রাম্পের ঘোষণার পরই জানাইয়া দিয়াছে, তাহারা কিন্তু ইহার মধ্যে নাই!

Advertisement

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও কি এই ঘোষণার জন্য যথেষ্ট প্রস্তুত ছিলেন? তাঁহার কূটনীতিতে কূটত্ব বা নীতির বিশেষ পরিচয় মিলে না, তবু গতিবিধি বলে, সম্প্রতি পশ্চিম এশিয়া লইয়া তিনি যে সব পদক্ষেপ করিয়াছেন, তাহার মধ্যে জেরুসালেম লইয়া এই সিদ্ধান্তের আগাম আভাসও ছিল না, তাহাদর সঙ্গে এই সিদ্ধান্তের সামঞ্জস্যও নাই। সে ক্ষেত্রে কি ধরিয়া লইতে হইবে, ইহা সত্যই অপ্রত্যাশিত ও আকস্মিক? এত বড় ঐতিহাসিক নীতি-পরিবর্তন এত আকস্মিক হইতে পারে? ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতাগ্রহণের পর বৎসর এখনও পূর্ণ হয় নাই, কিন্তু তিনি স্পষ্ট বুঝাইয়া দিয়াছেন— আলবাত পারে। তিনি এমনই বেপরোয়া চাল চালিতে পছন্দ করেন। সম্ভবত এই চালটির অর্থ ও ফলাফল কত সুদূরপ্রসারী, সে বিষয়ে তিনি অবগতও নহেন। তিনি ইজরায়েলকে খুশি করিতে চাহিয়াছেন। করিয়াছেন।

তবে, কূটনীতির দিক হইতে চালটি আনাড়ি হইলেও রাজনীতির দিক হইতে না-ও হইতে পারে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেই গোত্রের রাজনীতিক যিনি নিজের সংকীর্ণ স্বার্থের দিকে তাকাইয়াই বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিতে পা ফেলেন। বিশ্ব পরিবেশ চুক্তি হইতে পশ্চাদপসরণ, কিংবা জেরুসালেমকে ইজরায়েলের অন্তর্ভুক্ত বলিয়া স্বীকৃতি, সবই সেই একই মানসিকতা হইতে উদ্ভূত। দেশের রাজনীতির মঞ্চে তাঁহার সময় ভাল যাইতেছে না, বিশেষত জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে তাঁহার নূতন আইনবিধি প্রবল সমালোচনা আকর্ষণ করিতেছে। গত নির্বাচনে রাশিয়ার সংযোগ লইয়াও তাঁহার হেনস্তা কাটিতেছে না। সমালোচকরা তো আড়েবহরে বাড়িতেছেন বটেই, তাঁহার নিজের শিবিরের একাংশও তাঁহার প্রতি বিদ্বিষ্ট। এমতাবস্থায় নির্বাচনী প্রচারের সময় ইজরায়েলকে তুষ্ট করিয়া প্যালেস্টাইন-সমস্যা মিটাইবার যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়াছিলেন, তাহা কার্যে পরিণত করিয়া নিজের দৃঢ়চিত্ততার পরিচয় দেওয়াটা জরুরি হইয়া উঠিয়াছে, মার্কিন ইহুদি লবিকে তুষ্ট করিয়া প্রশাসনিক বাধা কমানোও দরকার হইয়া পড়িয়াছে। ঘরের রাজনীতির হিসাব মিলাইতে বাহিরের কূটনীতির পদক্ষেপ, ইহা একটি পরিচিত অসুখ। ট্রাম্পের জেরুসালেম উল্লম্ফনে সেই অসুখেরই প্রকাশ।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন