এক সফরে দুই পাখি। প্রধানমন্ত্রী মোদীর তাহাই লক্ষ্য ছিল। সেই লক্ষ্য যথাযথ ভাবে সাধিত। সুতরাং সফরকে এক দিক দিয়া সফল বলা চলে। তাঁহার ইজরায়েল সফর এমন ভাবেই পরিকল্পিত হইয়াছিল যাহাতে এক সফরেই তিনি ইজরায়েলের সহিত ভারতের দীর্ঘ নেহরু-যুগীয় অবস্থান হইতে এক লাফে সরিয়া আসিতে পারেন, এবং দুই, যাহাতে প্যালেস্তাইন তথা সামগ্রিক পশ্চিম এশিয়ার প্রতি ভারতের দীর্ঘ সহমর্মিতামূলক নীতিটি নূতন ভাবে রচনার মুখবন্ধটি তিনি রচনা করিতে পারেন। দুইটি বৈদেশিক নীতি পরিবর্তনের মধ্যে গুরুতর একটি অভ্যন্তরীণ সংযোগ আছে: তাহার নাম ইসলামবিরোধিতা। ইজরায়েল ও ভারত নামক দুইটি গুরুত্বপূর্ণ এশীয় দেশ আপাতত ইসলামবিরোধিতার সূত্রেই নিজেদের শক্ত করিয়া বাঁধিয়াছে। সেই বন্ধনের জোরেই ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে নরেন্দ্র মোদী ডাক নাম ধরিয়া ডাকিয়াছেন। যে কোনও রাষ্ট্রের প্রধান কি আর নেতানিয়াহুকে ‘বিবি’ বলিয়া সম্বোধন করিবার দুঃসাহস পান? আবার ওই বন্ধনের জোরেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী রীতি-বহির্ভূত ভাবে রামাল্লার মতো প্যালেস্তিনীয় অঞ্চল পরিদর্শন না করিয়াই চলিয়া আসিতে পারিয়াছেন, নেতানিয়াহুর সর্বতো সমর্থনে। আর, কোলাকুলির প্রথা তো এত দিনে নরেন্দ্র মোদীর কূটনীতির একটি নিজস্ব স্টাইল। তবু এই সফরে কোলাকুলির সময় নেতাদ্বয়ের ব্যক্তিগত রসায়ন একেবারে অন্য গোত্রের। আলিঙ্গনের এত উষ্ণতা মোদী অন্যত্র উপভোগ করিবার সুযোগ পান নাই।
অর্থাৎ মোদী যাহা চাহিয়াছিলেন, পাইয়াছেন। দুই রাষ্ট্রনেতা পরস্পরের পিঠ চাপড়াইয়া নিজেদের সভ্যতার গুণগান করিয়াছেন, নিজেদের সংস্কৃতির প্রাচীনতার গৌরবে ভাসিয়াছেন। যে ইজরায়েলি শিশুটি মুম্বই তাজ হোটেলের সন্ত্রাসে পিতামাতাকে হারাইয়াও ভাগ্যবলে বাঁচিয়া গিয়াছিল, তাহাকে লইয়া দুই জনে ছবি তুলিবার ব্যবস্থা করিয়াছেন। সব মিলাইয়া মোদীর হিন্দুত্ব মতাদর্শ ও ইজরায়েলের জায়নবাদী মতাদর্শের এক অবাধ উচ্ছ্বাস এই সফরের স্মৃতিতে ধরা থাকিল। মনোগ্রাহী হইলেও ইহা আসলে একটি সরলীকৃত ও তরলীকৃত বিশ্বদর্শনের দর্পণ। তাই দুই দেশের বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা বিষয়ক আদানপ্রদানও এই ভূদর্শনের ভূমি হিসাবেই প্রত্যক্ষ করা ভাল।
পাকিস্তান স্বভাবতই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এই সফর লইয়া উদ্বিগ্ন। বাস্তবিক, দক্ষিণ ও পশ্চিম এশিয়ার ভূরাজনীতিক ভারসাম্যটি এই বন্ধুত্ব টলাইয়া দিতে পারে। ইজরায়েলের সহিত এই অঞ্চলে ইসলামি দেশগুলির নানা জটিল সম্পর্কের অভিঘাত ভারত ও ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের উপরেও পড়িতে পারে। সেই ১৯৪৮ হইতে প্যালেস্তাইনের প্রতি তাহার সমর্থনের হাত বাড়াইয়া আসিয়াছে ভারত। আজ মোদীর আকস্মিক নীতি পরিবর্তন প্যালেস্তাইন-সমর্থক দেশগুলিকেও ভারতের প্রতি বিদ্বিষ্ট করিয়া দিতে পারে। পাকিস্তানের অস্বস্তি দেখিয়া মোদীর সাফল্যপ্রসাদ অবশ্যই আরও চড়িতেছে। কিন্তু মোদীর নিজের ও নিজের দলের স্বার্থের কথা ভুলিয়া দেশের কূটনীতি ও রাষ্ট্রনীতির কথা ভাবিলে স্পষ্ট হইবে যে, এত দ্রুত ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য পাল্টানো নীতি হিসাবে অত্যন্ত গোলমেলে।ইজরায়েল সফরটির সাফল্যকে তাই বিজেপির সাফল্য বলা চলে, ভারতের সাফল্য নয়।