হয়ে গেল কেন্দ্র বনাম রাজ্য লড়াই

আদর্শগত ভাবে এত ভিন্ন তিনটে দলের জোটটা হল কী করে? সহজ উত্তর— কংগ্রেস, এনসিপি আর শিবসেনা, তিন দলই যে কোনও মূল্যে বিজেপি-কে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিল। বিজেপি যে ভঙ্গিতে বিরোধী রাজনীতিকে ধ্বংস করতে চেয়েছে, ইডি-আয়কর লেলিয়ে দেওয়ার, বিরোধীদের জেলে পোরার হুমকি দিয়েছে, তাতে এ ছাড়া পথ ছিল না। 

Advertisement

সুধীর সূর্যবংশী

শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৯ ২৩:৩৫
Share:

বুড়ো হাড়ে যে এখনও ভেল্কি দেখানো যায়, শরদ পওয়ারকে দেখে সেটা বোঝা ছাড়াও মহারাষ্ট্রের নির্বাচনী ফলাফল থেকে আরও গোটা কয়েক কথা বলার থাকতে পারে। এক, রাজ্য রাজনীতিতে কোন দল কতখানি গুরুত্বের যোগ্য, এই ফলাফল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। দুই, লোকসভা আর বিধানসভা নির্বাচনের মধ্যে বিস্তর ফারাক— লোকসভায় এই রাজ্যেই কংগ্রেস পেয়েছিল মাত্র একটা আসন, এনসিপি সাকুল্যে পাঁচটা। তিন, নির্বাচনী সমীক্ষকদের মতোই বিজেপিও দেওয়াল লিখন পড়তে ভুল করেছিল। বিভিন্ন সমীক্ষা বলেছিল, বিজেপি-শিবসেনা জোট ২২০টা আসন পাবে, বিজেপি একাই পাবে ১৬০-১৭০টা। দেবেন্দ্র ফডণবীস প্রতিটি জনসভায় টিপ্পনী কেটেছিলেন যে রাজ্যে কোনও শক্তপোক্ত বিরোধীই নেই। এখন তিনি নিশ্চয় সেই দায়িত্ব পালন করবেন। তবে, এই নির্বাচনের ফলাফল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটা বলেছে, তা হল এই: কোনও একটি সমীকরণ দিয়ে এই ফলাফলকে বোঝা যাবে না। একে বোঝার একমাত্র উপায় মহারাষ্ট্রের রাজনীতির ভিন্ন ভিন্ন পরতগুলিকে বুঝতে চেষ্টা করা।

Advertisement

আদর্শগত ভাবে এত ভিন্ন তিনটে দলের জোটটা হল কী করে? সহজ উত্তর— কংগ্রেস, এনসিপি আর শিবসেনা, তিন দলই যে কোনও মূল্যে বিজেপি-কে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিল। বিজেপি যে ভঙ্গিতে বিরোধী রাজনীতিকে ধ্বংস করতে চেয়েছে, ইডি-আয়কর লেলিয়ে দেওয়ার, বিরোধীদের জেলে পোরার হুমকি দিয়েছে, তাতে এ ছাড়া পথ ছিল না।

এই নির্বাচনী ফলাফল বুঝতে হলে ছ’দশক পিছনে তাকাতে হবে। বম্বে প্রদেশ ভাগ হওয়ার সময় মুখ্যমন্ত্রী মোরারজি দেশাই বেঁকে বসেছিলেন, বম্বে শহরকে রাখতেই হবে গুজরাত রাজ্যের অংশ হিসেবে, তাকে মহারাষ্ট্রের অংশ হতে দেওয়া যাবে না। বিপুল বিক্ষোভ হয় তা নিয়ে। ১০৬ জন মরাঠি শহিদ হন। শিবসেনার উত্থান সে সময়েই— তাদের রাজনীতির একেবারে গোড়ায় আছে গুজরাতি-বিরোধী আবেগ। অন্য দিকে, মহারাষ্ট্রে বিজেপি চিরকালই গুজরাতি আর মারওয়াড়িদের দল হিসেবে পরিচিত। গ্রামীণ মহারাষ্ট্রের একাধিক কংগ্রেস নেতা মুম্বইয়ে শিবসেনাকে সমর্থন করেছেন তাঁদের মরাঠি পরিচিতির কারণে।

Advertisement

এই নির্বাচনের মুখে বিজেপি একাধিক ভাবে সেই মরাঠি-বিরোধিতার অভিযোগটাকেই উস্কে দিয়েছে। রাজ ঠাকরের নামে ইডি-র নোটিস পাঠিয়েছে। শরদ পওয়ারকে জড়িয়েছে মহারাষ্ট্র কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের কেলেঙ্কারিতে। পওয়ার কোনও সমবায় ব্যাঙ্কের পরিচালন পদে নেই। কাজেই, তাঁকে নোটিস পাঠানোয় রাজ্যবাসীও অবাক। এখান থেকেই নির্বাচনের খেলা ঘুরল। ভোটের আগে থাকতেই এনসিপি-র বিধায়ক-সাংসদ-নেতা ভাঙাচ্ছিল বিজেপি। তার ওপর সমবায় ব্যাঙ্ক মামলায় পওয়ারকে ইডি-র নোটিস পাঠানোয় গল্পটা দাঁড়িয়ে গেল দিল্লি বনাম রাজ্যের লড়াইয়ে। পওয়ার সুযোগ ছাড়েননি। তিনি বললেন, ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের আমল থেকেই মরাঠা বা মহারাষ্ট্র কখনও দিল্লির সামনে নতিস্বীকার করেনি। তিনিও করবেন না। শিবসেনা আর এমএনএস তাঁর এই কথাটাকে সমর্থন করল। বিজেপি কার্যত একা হয়ে গেল নির্বাচনী লড়াইয়ে।

অন্য দিকে, গত পাঁচ বছরে দেবেন্দ্র ফডণবীস সমবায় ক্ষেত্রের কোমর ভাঙার চেষ্টা করেছেন। অন্তত, মানুষ সে রকম ভাবেই দেখেছেন। আখচাষি আর চিনিকলের মালিকরাও যথেষ্ট মুশকিলে পড়েছেন। আখচাষ যথেষ্ট লাভজনক হয়নি। এনসিপি আর কংগ্রেসের একটা মস্ত সমর্থনভিত্তি হল সমবায়ক্ষেত্র। সেই ক্ষেত্রের সঙ্গে জড়িত চাষি আর ব্যবসায়ীরাও বিজেপির প্রত্যাবর্তনের ভয়ে ভীত ছিলেন। বিজেপি সেখানেও প্যাঁচে পড়েছে।

তার চেয়েও বড় কথা, দেবেন্দ্র ফডণবীস জাতপাতের সমীকরণ পড়তে ভুল করেছিলেন। নির্বাচনী প্রচারে তিনি বেশ কয়েক বার বলেছেন, শরদ পওয়ারের মরাঠা-বহুজন রাজনীতির দিন শেষ, এখন মহারাষ্ট্রের দেবেন্দ্র ফডণবীসের যুগ (অর্থাৎ, ব্রাহ্মণ যুগ) চলছে। তিনি মহারাষ্ট্রের ডিএনএ বুঝতে ভুল করলেন। এই রাজ্য শাহু মহারাজ, জ্যোতিবা ফুলে, ভীমরাও অম্বেডকরদের জন্ম দিয়েছে। রাজ্যের মানুষ ব্রাহ্মণ্যবাদে বিরক্ত। অবশ্য, জাতের রাজনীতিতে বিজেপির ভুলের ইতিহাস আর একটু পুরনো। রাজ্য রাজনীতিতে মরাঠা আধিপত্যের মোকাবিলা করতে আরএসএস অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির ভোটব্যাঙ্ক নিজেদের দখলে আনতে

মা-ধ-ব (মালি-ধাঙড়-বঞ্জারি) নীতি নিয়েছিল। ব্রাহ্মণ প্রমোদ মহাজনের পাশাপাশি উত্থান হয়েছিল বঞ্জারি সম্প্রদায়ের গোপীনাথ মুন্ডের। লেভ পাটিল সম্প্রদায়ের একনাথ খাড়সে, মালি সম্প্রদায়ের এন এস ফারান্ডে, তেলি সম্প্রদায়ের চন্দ্রকান্ত বাওনকুলে দলের গুরুত্বপূর্ণ ওবিসি নেতা হয়ে উঠছিলেন। কিন্তু, গত দফায় ব্রাহ্মণ ফডণবীসকে মুখ্যমন্ত্রী করায় বিজেপির অনগ্রসর শ্রেণির ভোটব্যাঙ্ক খানিক আশাহত হয়েছিল। তার পরই দলের অন্যতম প্রবীণ নেতা একনাথ খাড়সেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন ফডণবীস। অন্য অনগ্রসর নেতারাও ক্রমশ পিছনে চলে গেলেন। এতে বিজেপির ক্ষতিই হল।

মরাঠা-কুনবিরা বিজেপির বিরুদ্ধে জোট করল, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণিও বিজেপির সঙ্গে দূরত্ব বাড়াল। তার ফল সবচেয়ে স্পষ্ট বিদর্ভ অঞ্চলে। গত দফায় এই অঞ্চলের ৬২টি আসনের মধ্যে ৪৪টিতে জিতেছিল বিজেপি। এ বার সাকুল্যে ২১টায়। পশ্চিম মহারাষ্ট্রে এনসিপির আসনসংখ্যা বাড়ল তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে। বিজেপির মুখরক্ষা করল মুম্বই বা পুণের মতো শহরাঞ্চল। গ্রামের ভোট বিজেপির বিরুদ্ধে গিয়েছে।

মহারাষ্ট্রে শিবসেনার হিন্দুত্ববাদী পরিচিতির চেয়ে ঢের গুরুত্বপূর্ণ তাদের ‘মরাঠি মানুস পার্টি’ পরিচিতি। মরাঠিদের বড় অংশ বিশ্বাস করে, মুম্বইয়ে যদি ‘মরাঠি মানুস’-কে টিকে থাকতে হয়, তবে শিবসেনাকে চাই। এই মরাঠি পরিচিতির কারণেই এনসিপিরও শিবসেনার সঙ্গে জোট বাঁধতে অসুবিধা হয়নি। আর, কংগ্রেসও জানে, টিকে থাকতে হলে এই জোটে থাকতেই হবে। আপাতত মহারাষ্ট্রের রাজনীতি চলবে ‘সিলভার ওক’ থেকে— শরদ পওয়ারের বাড়ি। এই সরকার কত দিন টিকবে, সেটা নির্ভর করছে পওয়ারের ওপরই।

এই জোট সরকার যদি চলে, তবে তা দিল্লি, ঝাড়খণ্ড, বিহার বা পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যের জন্য মডেল হতে পারে। বিজেপির মতো সর্বাধিপত্যকামী দলকে বাইরে রেখে জোট সরকার চালানোর মডেল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন