গরিবকে টাকা দিলে তা নষ্ট হয় না

সরকার গরিবকে টাকা দিলে মদ-বিড়িতে তা উড়ে যাচ্ছে না। গরিব অলস হয়েও পড়ছে না। বরং খাবারের জন্য বেশি খরচ করছে সে। সন্তানের স্বাস্থ্য, শিক্ষার উন্নতি দেখা যাচ্ছে। একটা সময় ছিল, যখন গরিবকে অনেকে দেখত করুণার চোখে। আজকাল দেখে একটু বাঁকা নজরে। স্রেফ গরিব বলেই কী না পাচ্ছে লোকগুলো!

Advertisement

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৬ ০০:৪৩
Share:

একটা সময় ছিল, যখন গরিবকে অনেকে দেখত করুণার চোখে। আজকাল দেখে একটু বাঁকা নজরে। স্রেফ গরিব বলেই কী না পাচ্ছে লোকগুলো! জলের দরে চাল-গম পাচ্ছে, ঝুড়ি-কোদাল নিয়ে মাঠে গেলেই ১৭০ টাকা মজুরি জমা পড়ছে ব্যাঙ্কে। হাসপাতালে বাচ্চা হলে হাতে কড়কড়ে টাকা, তার পর বাচ্চার অঙ্গনওয়াড়ির খিচুড়ি থেকে মিড ডে মিলের ভাত-ডাল, ইস্কুলের জুতো-জামা-বই-সাইকেল, মেয়ে হলে ইস্কুল শেষে ২৫ হাজার টাকা, সরকার হাত উপুড় করেই রয়েছে।

Advertisement

এত দেওয়া কি ভাল?

কেবল ঈর্ষার জ্বালা থেকে নয়, গরিবের ভাল চেয়েও প্রশ্নটা তোলা যেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকানরা যেমন চিরকালই জোর গলায় বলে এসেছেন, গরিবকে দয়া করা মানে চিরকালের জন্য সরকার-নির্ভর করে তোলা। আর পাঁচ জনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে রোজগারের তাগিদটাই তো হারিয়ে ফেলবে সে। অলস, অদক্ষ কিছু মানুষ তৈরি করাই কি সরকারের কাজ? আজ প্রায় সেই একই সুরে কথা বলেন এ দেশের মাঝারি চাষিরা। একশো দিনের কাজে গিয়ে দাঁড়ালেই টাকা মেলে যদি, ধান রোয়া, ধান কাটার কাজ করতে লোকে আসবে কেন? টাকা দিয়েও খেতমজুর মিলছে না।

Advertisement

তা ছাড়া, টাকাটা যে জন্য দেওয়া, সত্যিই কি সে কাজে লাগে? দু’টাকা কিলো চাল বাজারে ১৪ টাকায় বিক্রি হয়ে চোলাইয়ের ঠেকে খরচ হচ্ছে, এমন হরদম শোনা যায়। একশো দিনের মজুরির টাকার কতটা বিড়ি-মদে উড়ে যাচ্ছে, কে দেখছে? করদাতার টাকা গরিবকে দিয়ে ভোট-কুড়োনো নেতাদের লাভ হতে পারে, দেশের লাভ কী?

এমন উদ্বেগ কতটা ধোপে টেকে? তা বুঝতে অর্থনীতির বেশ কিছু গবেষক খতিয়ে দেখেছেন, যখন গরিবকে টাকা (বা অধিক রোজগারের উপায়) দেওয়া হচ্ছে, তখন তা আদৌ কাজে লাগছে, না কি নষ্ট হচ্ছে। দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব এশিয়ার নানা দেশে সাতটি প্রকল্প থেকে পাওয়া তথ্য-পরিসংখ্যান কিন্তু বলছে, টাকাটা নষ্ট হচ্ছে না, কাজেই লাগছে। সেই লাভ কেবল তাৎক্ষণিক, এমনও নয়। পাঁচ-সাত বছর পরেও দেখা যাচ্ছে, টাকা পাওয়ায় পর যাঁরা রোজগার বাড়িয়েছিল, তাঁরা তা ধরে রাখতে পেরেছেন। ফের গরিব
হয়ে যাননি।

উদাহরণ আছে এ রাজ্যেই। ওই ছ’টি প্রকল্পের একটি হয় মুর্শিদাবাদে। অতি গরিব ৩০০টি পরিবারকে বেছে নিয়ে, তাদের রোজগার বাড়াতে ছাগল, শুয়োর, গরু বিলি করা হয়েছিল বছর আট-দশ আগে। অন্য ভাবে রোজগার বাড়াতে চাইলে তার উপকরণও (যেমন ধান ভানার ঢেঁকি) দেওয়া হয়েছিল। এই পরিবারগুলিকে এক বছর ধরে দৈনিক ২১ টাকা করে দেওয়া হয়, যাতে অভাবের তাড়নায় তারা ছাগল-গরু বিক্রি করে না ফেলে। সেই সঙ্গে প্রাণী পালন, টাকাপয়সা জমাখরচের ট্রেনিং, সাহস-সহায়তা জোগাতে প্রতি ৫০ পরিবার পিছু এক জন প্রশিক্ষক নিয়োগ করা হয়। ‘বন্ধন’ ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার (এখন ব্যাঙ্ক) এই প্রকল্পের শেষে দেখা গেল, ৯৪ শতাংশ পরিবারই বাড়তি আয় করছেন। নিয়মিত ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে তা শোধ করে ফের ঋণ নেওয়ার শৃঙ্খলায় চলে এসেছেন। সাত বছর পরে মূল্যায়ন করে দেখা গিয়েছে, কেউ আগের অতি-দারিদ্রে ফিরে যাননি। এককালীন সম্পদ ও প্রশিক্ষণ দীর্ঘমেয়াদি ফল দিচ্ছে।

উত্তর উগান্ডায় প্রায় এমন ভাবেই অতি-দরিদ্র মেয়েদের হাতে দেওয়া হয়েছিল দেড়শো ডলার, ব্যবসার প্রশিক্ষণ। ব্যবসা শুরুর পর কিছু দিন দেখভালও করেন প্রশিক্ষক। তার ১৬ মাস পরে দেখা গেল, এই মেয়েদের রোজগার প্রায় ডবল হয়েছে, ব্যবসাও বেড়েছে দ্বিগুণ। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইথিয়োপিয়া, ঘানা, হন্ডুরাস, পেরুতে অতি-দরিদ্রদের অনুদান ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার সাতটি প্রকল্প থেকে দেখা যাচ্ছে, বছরখানেক পর থেকেই রোজগার বাড়ছে, তিন-চার বছর পরেও সেই উন্নতি বজায় থাকছে। যার একটা লক্ষণ, আগের চাইতে ভাল খাওয়াদাওয়া করছে পরিবারগুলি। যাঁরা দিনে দু’বার খেতেন, দেখা যাচ্ছে তাঁরা আরও এক বার খাচ্ছেন। কোথাও বা গবেষকরা মেপে দেখেছেন, আগের চাইতে দিনে ৭০০ ক্যালরি বেশি
খাচ্ছেন পরিবারের সদস্যরা। খাবারের জন্য খরচ হচ্ছে বেশি।

অনুদান দিয়ে দারিদ্র কমানোর এই যে ম়়ডেল, তার পথিকৃৎ কিন্তু বাংলাদেশ। সে দেশের একটি অসরকারি সংস্থা (ব্র্যাক) গ্রামীণ বাংলাদেশের ৪০টি এলাকায় অতি-দরিদ্র, অক্ষরপরিচয়হীন মেয়েদের তাঁদের পছন্দসই কাজের জন্য (যেমন ছাগল-মুরগি পালন, ছোটখাটো মুদির দোকান) এককালীন টাকা দেয়, সেই সঙ্গে প্রায় দু’বছরের প্রশিক্ষণ আর নজরদারি চলে। ২০০৭ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের মূল্যায়ন হয়েছে বেশ কয়েক বার। তাতে কেবল যে বাড়তি রোজগার (৩৮ শতাংশ) ধরা পড়েছে তা-ই নয়। দেখা যাচ্ছে, এই মেয়েদের জীবনযাত্রাও বদলেছে। তাঁদের জীবনশৈলী এলাকার মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির কাছাকাছি পৌঁছেছে।

যে গবেষকরা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের এই প্রকল্পটির উপর নজর রাখছেন, তাঁরা লিখছেন, ‘‘এই গবেষণায় স্পষ্ট প্রমাণ মিলছে যে অতি-দরিদ্রদের যে রোজগারের জন্য, বা অন্যান্য কারণে, অ-গরিবদের উপর নির্ভর করতেই হবে এমন নয়। গ্রামীণ সমাজে গরিবদের অবস্থান যে নির্দিষ্ট, অপরিবর্তনীয়, এমনও নয়। যদি তাঁদের জন্য যথেষ্ট পুঁজি এবং দক্ষতার ব্যবস্থা করা যায়, তা হলে অন্যান্য বাধা (সামাজিক বিধিনিষেধ, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণের অভাব, ক্ষতিকর অভ্যাস, বিনিয়োগ-লাভ বিষয়ে ভুল বা অস্পষ্ট ধারণা) এত বড় হয়ে দাঁড়ায় না, যে তা অতি-বঞ্চিত মেয়েদের স্বাধীন, সফল ব্যবসায়ী হয়ে ওঠা আটকাতে পারে।’’ এ কথাটা যে সব দেশে, সব সংস্কৃতিতে সত্য, গত বছর দশেকে তার যথেষ্ট প্রমাণ মিলেছে।

আরও কয়েকটা চালু ধারণায় ধাক্কা দিয়েছে এই প্রকল্পগুলি। সাধারণত মনে করা হয়, একসঙ্গে বেশি টাকা দিলে গরিব সামলাতে পারবে না। কিছু কিছু করে দেওয়াই ভাল। নানা প্রকল্প থেকে পাওয়া তথ্য খতিয়ে দেখে কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, মাসে মাসে কিছু টাকা দিলেও রোজগার বাড়ে, তবে তুলনায় সামান্য। একসঙ্গে বেশি টাকা দিলে রোজগার বরং এক লাফে অনেকটা বাড়ছে।

টাকা পেলে গরিব অলস হয়ে যায় কি না, তারও উত্তর মিলেছে। এক কথায় সে উত্তর: না। যারা প্রকল্পে টাকা পেয়েছে, আর যারা পায়নি, তাদের কাজের সময়ে (বাইরে ও ঘরে) মেপে দেখা গিয়েছে, হেরফের মেলেনি। বাংলাদেশে দেখা গিয়েছে, টাকা-ট্রেনিং পাওয়া মেয়েরা বরং আগের চাইতে অনেক বেশি সময় পরিশ্রম করছে। তবে মজুরি খাটার সময় কমিয়ে, প্রাণী পালনের মতো স্বরোজগারের কাজে বেশি সময় দিচ্ছে তারা। তাই বাইরে থেকে মনে হতে পারে, টাকা পেলে গরিব কাজে আসে না। আসলে হয়তো তারা আরও লাভজনক কাজ করছে।

তবে দুটো বিষয় খেয়াল করতে হবে। এক, এই সব প্রকল্পে গরিবকে যে টাকাটা গোড়ায় দেওয়া হচ্ছে, সেটা অনুদান। ফেরত দেওয়ার কোনও শর্ত সেখানে নেই। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে ব্যবসা করে গরিব দারিদ্র এড়াতে পারে কি না, সে প্রশ্ন সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে বলা চলে যে, বাজারের নিয়মে এই ধরনের কাজ হবে না। সরকার বা অসরকারি সংস্থাকে দারিদ্র নিরসনের লক্ষ্যে গোড়ার পুঁজিটা দিতে হবে গরিবকে।

আর দুই, টাকার সঙ্গে সহায়তাও প্রয়োজন। প্রশিক্ষণ, নিয়মিত কাজের খোঁজখবর, পরামর্শ, বেশ কয়েক মাস এটা চালাতে হবে।

কিন্তু যখন প্রশিক্ষণের প্রশ্ন নেই? যখন খাদ্যের জন্য, কিংবা সন্তানের পড়াশোনার জন্য স্রেফ টাকা দিচ্ছে সরকার? তখন কি মদ-তামাকে নষ্ট হয় না টাকাগুলো?

উত্তর খুঁজতে বিশ্বব্যাঙ্কের গবেষক ডেভিড ইভান্স নানা দেশের ১৯টি এমন প্রকল্প দেখেছেন, যেখানে শর্তসাপেক্ষে (যেমন, সন্তানকে স্কুলে পড়ানোর জন্য), কিংবা শর্ত ছাড়াই, টাকা দেওয়া হচ্ছে গরিবকে। তিনি বলছেন, এক জনও ওই টাকা মদ খেয়ে ওড়াচ্ছে না, তা বলা চলে না। কিন্তু তারা অতি সামান্য, হিসেবে আসে না। বাড়তি টাকা পাওয়ার পর মদ-তামাকের খরচ বাড়েনি, এমনই দাবি করছেন ইভান্স। ‘‘পেরুতে দেখা গিয়েছে বটে, হাতে টাকাটা এলেই লোকের রোস্টেড চিকেন, কিংবা চকোলেট কেনার একটা ঝোঁক থাকে। কিন্তু আশা করি পোড়-খাওয়া কর্তারাও সে জন্য গরিবকে দুষবেন না,’’ লিখছেন তিনি।

গত দশ-বারো বছর ধরে নানা পরীক্ষানিরীক্ষায় স্পষ্ট হয়েছে, গরিবকে টাকা দেওয়া ‘বাজে খরচ’ নয়। বরং হাতে টাকা পেলে খাবারের জন্য সে বেশি খরচ করে। সন্তানের স্বাস্থ্য, শিক্ষার উন্নতি হয়। আর যদি এককালীন টাকার সঙ্গে প্রশিক্ষণও মেলে, তা হলে বাড়তি রোজগার করে আর্থ-সামাজিক অবস্থানে কয়েক ধাপ উঠে আসে সে। কয়েক বছরের মধ্যেই।

এমন ভাল খবরে মধ্যবিত্তের মন ভাল হবে কি? গরিবের রোজগার বাড়া মানে তার মজুরি, মাইনে বাড়া। সেই সঙ্গে তার সামাজিক উত্থানটাও অনেকে ভাল চোখে দেখেন না। সে দিনই এক ‘কাজের মাসি’ দুঃখ করছিলেন, তিনি ছুটি চাইলে বাড়ির মালকিন বলেছেন, ‘‘তা হলে তোমার মেয়েকে পাঠিয়ে দিও’’। মেয়ে কলেজে পড়ে, বলতে মালকিনের প্রশ্ন, ‘‘তাতে কী হয়েছে’’? গরিব যে বংশানুক্রমে খেতমজুরি, মুটেগিরি, ঝি-গিরি করবে, সেটাই ধরে নিয়েছেন পাকাবাড়ির কর্তা-গিন্নিরা। বর্ণব্যবস্থা আর দারিদ্র সেই ধারণাটা পোক্ত করেছে। এ বার হয়তো ধারণাটা নড়বড়ে হবে। গরিবের হাতে টাকা এলে সে অন্তত তার অনাদর করবে না।

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি’তে (এমআইটি) অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন