হরিয়ানা দেখিয়ে দিল, কী ভাবে ন্যক্কারজনক দৃশ্যের নীরব সাক্ষী থাকতে পারে ভরা বাজার। ছবি: সংগৃহীত।
দৃশ্যটা রচনা হওয়ার পটভূমি তৈরিই হচ্ছিল বেশ কিছু কাল ধরে। তবু, সভ্যতা খাদের অত কিনারে গিয়ে কি পৌঁছবে, এই বিশ্বাসে ভরসাও রাখতে চেয়েছিলাম আমরা। সেই বিশ্বাসটির মৃত্যু ঘটিয়ে বাস্তবে কাণ্ডটা করেই দেখাল হরিয়ানা। বিজেপি শাসিত এই প্রদেশের ক্ষুদ্র একটি অঞ্চল মহেন্দ্রগড় দেখিয়ে দিল, শুধুমাত্র কাশ্মীরি হওয়ার কারণে দু’জন যুবককে বাইক থেকে নামিয়ে কী ভাবে বেধড়ক পেটাতে পারে জনা পনেরো দুষ্কৃতী। মনোহরলাল খট্টরের ভূমি দেখিয়ে দিল, কী ভাবে ওই ন্যক্কারজনক দৃশ্যের নীরব সাক্ষী থাকতে পারে ভরা বাজার।
কিন্তু খুব আশ্চর্য কাণ্ড ঘটল কি? গত কয়েক বছর ধরে জাতীয়তাবাদের নামে এক উগ্রতার চর্চা কি দেখতে পাচ্ছি না আমরা? সেই চর্চায় মেরুকরণ তথা বিভাজনের বীজমন্ত্র ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ক্রমাগত, বুঝতে পারছিলাম না আমরা? কাশ্মীরি ভূমিপুত্রের ভাবনা-আকরণ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে দেওয়ার একটা কৌশল দেখতে পাইনি? ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচে কাশ্মীরের বাড়ি-বাড়িতে পাক পতাকা ওড়ানোর সম্ভাবনা অথবা ফোটোশপের কারিকুরি নিয়ে বিস্তর জলঘোলার সাক্ষী থাকিনি? পদ্মাবতকে ঘিরে জাতিগত গরিমার সোচ্চার উল্লাস, মুঘল ইতিহাসকে নতুন করে দেখা বা লেখার চেষ্টা অথবা বহুত্ববাদের পথ থেকে সরে এসে একবাদী মার্গের পথে যাত্রার মধ্যে নির্দিষ্ট একটা নকশা থাকছে কি না, তা নিয়ে তর্ক করিনি আমরা?
সেই নকশায় মহেন্দ্রগড়কে ফেলে দেখলে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে আসবে দৃশ্যপট। এই পটভূমিকায় স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র দুই কাশ্মীরি যুবককে কোনও কারণ ছাড়া পিটিয়ে দেওয়া যায়। জবাবদিহির প্রয়োজন পড়ে না, না সাক্ষী জনতার কাছে, না প্রশাসনের কাছে। হিন্দু ভাবাবেগে ইন্ধন-জোগানো উগ্র জাতীয়তাবাদের পতাকা কাঁধে তুলে নেওয়া এই দুষ্কৃতীদের উদ্দেশে পুলিশের প্রত্যাশিত প্রশ্রয় থাকে। যথাযথ তদন্তের আগেই তাই পুলিশি বার্তা বেরিয়ে আসে, কাশ্মীরি হওয়ার কারণেই এই যুবকদের মারা হয়েছে, এমনটা নয়।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
এই দেশ বহুর। ভাষা-সংস্কৃতি-ধর্ম-খাদ্যাভাসের অজস্র ভিন্নতা সত্ত্বেও এমন সুদৃঢ় ভারতীয়ত্ব কী ভাবে আমরা রক্ষা করতে পেরেছি, তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। পেরেছি, তার মূল কারণ, আমরা বিবিধের মাঝে মহান মিলনের মন্ত্রোচারণ করে এসেছি বহু শতাব্দী ধরে। সেই মূল ভিত্তিতে কুঠারাঘাত হচ্ছে এখন, রক্তক্ষরণ হচ্ছে মহেন্দ্রগড়ে বা ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়।
আরও পড়ুন
বিজেপি শাসিত হরিয়ানায় দুই কাশ্মীরি ছাত্রকে মারধর, হেনস্থা
সাবধান হওয়ার সময় এসেছে। পূর্বপুরুষেরা উত্তরাধিকার হিসাবে আমাদের কাঁধে চাপিয়ে গিয়েছেন পতাকা, তাকে বহন করার শক্তি অর্জন আমাদের দায়িত্ব, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য যথোচিত মর্যাদায় তাকে রক্ষা করা আমাদের অঙ্গীকার।