সম্পাদকীয় ২

পরীক্ষা লোকধর্মেরও

আপন আপন নিরাপদ কোটরে বসিয়া যাঁহারা সোশ্যাল মিডিয়ায় এত বড় অমানবিকতার প্রশ্রয় দিতেছেন, উল্টাপাল্টা ছবি ও বক্তব্য পেশ করিতেছেন, প্রচারে মাতিয়া হিংসার আবাহন ছড়াইতেছেন, তাঁহারা প্রত্যেকে এই ভয়ংকর দুঃসময়ের জন্য অপরাধী।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৭ ০০:১৯
Share:

অন্যের উপর দোষ চাপাইয়া নিজের প্রতি অন্ধ হইয়া থাকা অত্যন্ত সুবিধাজনক অভ্যাস। কিন্তু সেই দোষারোপ যখন হিংসাবৃত্তির পর্যায়ে চলিয়া যায়, তখন অভ্যাসটিকে অপরাধ হিসাবে না দেখিয়া উপায় নাই। আজিকার সময় তেমন একটি সময়। পারস্পরিক দোষারোপের বন্যায়, এবং সেই দোষারোপের সম্মিলিত চর্চায় পশ্চিমবঙ্গের সমাজ এক ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করিয়া ফেলিয়াছে, যেখানে চর্চাকারীরা সমাজের সুবিধাভোগীদের জায়গায় থাকেন, এবং তাঁহাদের চর্চার আগুন পুড়াইয়া খাক করে নিরীহ সাধারণ মানুষজনকে। বসিরহাটের ঘটনায় যাঁহারা আক্রান্ত ও সংকটাপন্ন, সম্প্রদায়-নির্বিশেষে, তাঁহাদের অধিকাংশেরই কোনও ধারণা নাই, ফেসবুকে কী ঘটিয়াছে, কেনই-বা তাহা এত গুরুতর, কে কাহাকে খবর দিতেছে, কে বেশি অস্ত্র লইয়া আসিতেছে, ইত্যাদি বিষয়ে। তাঁহারা আপন আপন জীবনসংগ্রামে ব্যস্ত ছিলেন, এমন সময়ে তাঁহাদের উপর নামিয়া আসিল অগ্নিময় সংঘর্ষের লেলিহান শিখা। এই পরিস্থিতির সামনে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি মানুষকে দায় স্বীকার করিতে হইবে। প্রত্যেককে ভাবিতে হইবে, তাঁহারা ঠিক কী চান, ধর্মের শান্তি না অধর্মের দাবানল।

Advertisement

আপন আপন নিরাপদ কোটরে বসিয়া যাঁহারা সোশ্যাল মিডিয়ায় এত বড় অমানবিকতার প্রশ্রয় দিতেছেন, উল্টাপাল্টা ছবি ও বক্তব্য পেশ করিতেছেন, প্রচারে মাতিয়া হিংসার আবাহন ছড়াইতেছেন, তাঁহারা প্রত্যেকে এই ভয়ংকর দুঃসময়ের জন্য অপরাধী। তাঁহারা নিজেদের এই আত্মপ্রশিক্ষণটি দেন নাই যে, ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপে কিছু দেখিলেই তাহাকে ‘সত্য’ বলিয়া ধরিয়া লওয়া যায় না। যে কোনও ছবি বা বার্তা ‘আসল’ না হইয়া ‘নকল’ হইতে পারে। দ্বিতীয়ত, ছবি বা বার্তা যদি সত্য-ও হয় এবং আক্রমণাত্মক হয়, সে ক্ষেত্রেও বৃহত্তর বিপদ ঠেকাইবার জন্য আত্মসংবরণ প্রয়োজন। লাঠি ও আগুন লইয়া রাস্তায় বাহির হওয়া কোনও সমাধান নয়। কেবল রাজধর্ম নয়, লোকধর্ম বলিয়াও একটি গুরুত্বপূর্ণ বস্তু আছে। লোকধর্ম এই ভাবে অবক্ষয়ের পথে হাঁটিতে শুরু করিলে সমাজকে বিলোপ হইতে বাঁচানো মুশকিল।

সত্যকারের ধর্মবোধ যাঁহাদের আছে, তাঁহারা অবশ্য জানেন, ভিন্-ধর্মকেও প্রতিবেশীর মতো পাশে রাখিতে হয়। সত্যকারের ধর্মভাব না থাকিলেই দাঙ্গাবাজিতে প্রবৃত্ত হওয়া সম্ভব। তাঁহাদের ইন্ধন জোগায় রাজনীতি। ভারতের ইতিহাস বহু বার প্রমাণ করিয়াছে, রাজনীতির ঠেলা ছাড়া এ ভাবে ধর্মের নামে সংঘর্ষ বাধিতে পারে না। সুতরাং প্রত্যেকে প্রশ্ন করুন, কে বা কাহারা এই অশান্তিতে ইন্ধন দিতেছেন। কেন তাঁহারা রাজনৈতিক নেতাদের সংকীর্ণ ক্ষমতালিপ্সাকে প্রশ্রয় দিতেছেন। কোনও অপরিণামদর্শী বালক অন্যায় করিলে তাহা ‘হিন্দু’ সমাজের দোষ নয়, কোনও গুন্ডা বাড়িতে আগুন জ্বালাইলে তাহা ‘মুসলিম’ সমাজের দোষ নয়। ওই বালক কিংবা ওই গুন্ডার পিছনে যে ভুল রাজনীতির তর্জন, তাহার বিরোধিতার বদলে মানুষের বিরোধিতা করা অসহনীয় অন্যায়। আর, যে নেতারা কত প্রাণ বিপন্ন করিবার ক্ষমতা তাঁহাদের দেখিয়া আত্মপ্রসাদে মাতিয়াছেন, তাঁহারা জানুন, এই নিদারুণ আগুন তাঁহাদেরও দ্রুত গ্রাস করিবে। ধ্বংসের উত্তরে মহাধ্বংস নামিয়া আসিবে। সুতরাং সাবধান।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন