যে কোনও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতির মূল কথা কিন্তু জনসমর্থন। সব ক্ষেত্রেই জনমত অর্থাত্ সংখ্যা গরিষ্ঠের মতই যথার্থ কি না, সে নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু গণতন্ত্রে সংখ্যা গরিষ্ঠের মতই যে চূড়ান্ত, তা নিয়ে কোনও তর্ক চলে না। তাই দখলদারির রাজনীতিতে মেতে— জনাদেশকে অস্বীকার করার প্রবণতা গণতন্ত্রের পক্ষে মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়। কিন্তু তেমনই ঘটছে।
শিলিগুড়ির পরাজয় সম্ভবত এখনও মেনে নিতে পারেনি এ রাজ্যের শাসক দল। অশোক ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে বিরোধী বোর্ড গঠিত হওয়া ইস্তক শিলিগুড়ি নগর নিগমের সঙ্গে সঙ্ঘাতে তৃণমূল। কখনও আর্থিক অসহযোগিতার অভিযোগ, অভিযুক্ত রাজ্য সরকার। কখনও পুরবোর্ডের কাজে অনর্থক বাধা সৃষ্টির অভিযোগ, অভিযুক্ত রাজ্যের শাসক দল। অধিবেশন কক্ষের মধ্যেই এ বার আক্রান্ত হলেন শিলিগুড়ির মেয়র। খোদ বিরোধী দলনেতার বিরুদ্ধেই হামলার অভিযোগ। তৃণমূল স্বাভাবিক ভাবে অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিন্তু বার বার অভিযোগ অস্বীকার করলেই দায়মুক্ত হওয়া যায় না। প্রথমত, তৃণমূল রাজ্যের শাসক দল, তাদের দায় অনেক বেশি। দ্বিতীয়ত, সঙ্ঘাত বার বার সেখানেই তীব্র হচ্ছে, যেখানে বিরোধী দলগুলির প্রতি মানুষ সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। তৃণমূলের দিকে আঙুল ওঠা খুব স্বাভাবিক নয় কি?
সব ‘আমাদের’ হবে, ‘আমরা’ সবাই জিতব, ‘আমরা’ সর্বত্র জিতব, সব কিছু ‘আমাদের’ দখলেই থাকবে— এই মানসিকতা থেকেই জন্ম নেয় শিলিগুড়ির মতো সঙ্ঘাত। আর এই মানসিকতার জন্ম হয় গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে অবস্থিত এক রাজনৈতিক কানাগলি থেকে। এই সব কানাগলির মালিক তৃণমূল নয়, বাম নয়, কংগ্রেস নয়, বিজেপি নয়। রাজনীতিকের মুখোশ পরা কিছু দখলদার এই কানাগলিগুলোর নিয়ন্ত্রক। এই দখলদাররা শুধু পঞ্চায়েত বা পুরবোর্ড বা সরকারের দখল নিয়ে সন্তুষ্ট হয় না, সমগ্র গণতান্ত্রিক পরিসরকেই এরা গ্রাস করতে চায়। সেই কারণেই শিলিগুড়িতে বাম মেয়র আক্রান্ত হন, হাওড়ার শিবপুরে বিজেপি-কে পথে নামতে দেখলেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, কংগ্রেস নেতা দলবদলে রাজি না হওয়ার পরে তাঁর বিরুদ্ধে তছরুপের অভিযোগ দায়ের হয়।
বিপুল জনাদেশ নিয়ে আপনি ক্ষমতায় এসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ রাজ্যের প্রতিটি জনাদেশের মর্যাদা রক্ষা করার দায় আপনারই। সে দায়িত্ব যদি পালন করতে পারেন, তৃণমূলেরও মঙ্গল, গণতন্ত্রেরও মঙ্গল। আর জনাদেশের প্রতি নিজের দায়বদ্ধতা যদি বিস্মৃত হন, তা হলে কিন্তু তৃণমূলও এক দিন দখল হয়ে যেতে পারে। মনে রাখবেন।