খুবই গর্বের কথা, কিন্তু এই গর্ব কি আমাদের সাজে?

আমাদের সংবিধান প্রণেতারা স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শ সামনে রেখে বহু ভাষা, বহু ধর্ম, বহু সংস্কৃতির বৈচিত্রপূর্ণ দেশের শাসনতন্ত্র যেমন হওয়া উচিত, তেমনই এক মূল্যবান দলিল রচনা করে গেছেন।

Advertisement

কৃষ্ণা বসু

শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৭ ০০:০০
Share:

দলতন্ত্র?: এনডিএ-র রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে রামনাথ কোবিন্দের নাম ঘোষণার পর পটনায় বিজেপি কর্মীদের উচ্ছ্বাস, ১৯ জুন। ছবি: পিটিআই

গত বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রশ্নটি মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করছিল, আফটার প্রণববাবু, হু? শাসক দল তাদের প্রার্থী ঘোষণা করে দেওয়ার পর ভেবেছিলাম জবাবটা তো পেয়ে গিয়েছি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, প্রশ্নটি মনের মধ্যে রয়ে গেল অন্য এক অর্থবহ রূপে। তখন ভেবেছিলাম পরবর্তী কে হবেন? এখন বিস্মিত জিজ্ঞাসা, আফটার প্রণববাবু, ইনি কে? চার দিকে একই প্রশ্ন ধ্বনিত হচ্ছে— ইনি কে, ইনি কে!

Advertisement

অপরিচিত প্রার্থী হওয়া অবশ্যই কোনও দোষের ব্যাপার নয়, ইনি নিশ্চয়ই কোনও বিশেষ গুণসম্পন্ন হবেন। আমাদের সংবিধান প্রণেতারা স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শ সামনে রেখে বহু ভাষা, বহু ধর্ম, বহু সংস্কৃতির বৈচিত্রপূর্ণ দেশের শাসনতন্ত্র যেমন হওয়া উচিত, তেমনই এক মূল্যবান দলিল রচনা করে গেছেন। আমরা গর্বের সঙ্গে বলতে পারি, সংবিধানে সকল নাগরিকের সমান অধিকার স্বীকৃত। অতএব যে কোনও নাগরিক রাষ্ট্রপতি হতে পারেন, তাঁর জাতি, ধর্ম, তিনি পুরুষ, বা মহিলা, তিনি ধনী বা দরিদ্র— এ সব বিবেচ্য নয়।

আজকাল কেমন যেন ভয় হয়, সংবিধানের এই সমানাধিকারের আদর্শ আমরা ঠিক মতো অনুধাবন করতে পেরেছি তো? তবে কেন এক ধরনের উলটপুরাণ সৃষ্টি হচ্ছে? মনে পড়ে প্রতিভা পাটিলের নাম রাষ্ট্রপতি পদে ঘোষণা করার পর সনিয়া গাঁধী বেশ অহংকারের সঙ্গে আমাকে বলেন, দেখেছ তো, কংগ্রেসই প্রথম এক জন মহিলাকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত করতে চলেছে। কথাটা আক্ষরিক অর্থে সত্যি। তবু সনিয়ার মন্তব্যে একটা খটকা মনের মধ্যে লেগেছিল। এক জন মহিলার রাষ্ট্রপতি হওয়ার সমান অধিকার আছে, সংবিধান তা-ই বলে। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে আমরা বিষয়টি এমন ভাবে দেখি, যেন কারও মহিলা পরিচিতি দেশের উচ্চপদে যাওয়ার একমাত্র যোগ্যতা। আর জীবনে কোনও কৃতিত্বের দাম নেই, শুধুমাত্র আনুগত্যই সব।

Advertisement

যখনই নতুন রাষ্ট্রপতির সন্ধান শুরু হয়, তখনই সে ব্যক্তি হিন্দু, না মুসলমান; ব্রাহ্মণ, না দলিত; নারী, না পুরুষ— এই সব পরিচিতি প্রাধান্য পায়। কোনও রাজনৈতিক দল যদি বিশেষ কোনও সম্প্রদায়ের এক জনকে মনোনীত করে, অপর দলও তাকে টেক্কা দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগে। যোগ্যতর ব্যক্তির সন্ধানে না গিয়ে, একই বিশেষ সম্প্রদায়ের মধ্যে খোঁজ চলে।

ভারতের রাষ্ট্রপতি দলিত সমাজ থেকে উঠে এসেছেন, আবার যিনি রানার-আপ, তিনিও পিছিয়ে পড়া সমাজের। এক দিক থেকে দেখলে এ তো খুবই আনন্দের ও গর্বের কথা। পৃথিবীর মানুষের কাছে আমরা বড়াই করতে পারব বহু যুগ ধরে, যাঁরা অত্যাচারিত, নিপীড়িত হয়েছেন, আজ আমরা তাঁদের যোগ্য সম্মান দিয়েছি। কিন্তু এই গর্ব কি সত্যিই আমাদের সাজে? আমরা সংবিধানে প্রদত্ত সাম্যের আদর্শকে মর্যাদা দিতে কি এই কাজ করেছি? নাকি এর পিছনে আছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সংকীর্ণ চাতুরির খেলা ও ক্ষমতার লিপ্সা?

শ্রীযুক্ত রামনাথ কোবিন্দ এক অপরিচিত মুখ, হয়তো তিনি নানা বিষয়ে দক্ষ। কিন্তু জন আলোচনা অনুসারে, তিনি প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর একান্ত সহযোগী অমিত শাহের পছন্দের প্রার্থী দুটি কারণে। এক, তিনি এক বিশেষ দলীয় মোর্চার সভাপতি ছিলেন। দুই, তিনি সংঘের সঙ্গে বহু দিন যুক্ত ও ঘনিষ্ঠ।

এব্রাহাম লিংকন যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হন, তখন সকলে বলেছিলেন— ‘ফ্রম দ্য লগ কেবিন টু দ্য হোয়াইট হাউজ’। দরিদ্র অবস্থা থেকে লিংকন প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, কিন্তু হোয়াইট হাউজ যাওয়ার আগেই তাঁর নিজের কৃতিত্ব সর্বজনবিদিত।

ভারতের মতো বিশাল, বহুমাত্রিক গণতন্ত্রের দেশে যিনি রাষ্ট্রপ্রধান হবেন, তিনি কোনও না কোনও দিকে কীর্তিমান বা যশস্বী, জীবনের কোনও ক্ষেত্রে তাঁর আছে বিশিষ্ট অবদান— এমন আশা করা যেতেই পারে। তা তিনি দরিদ্র বা নারী অথবা নিম্নবর্গের মানুষ— যা-ই হোন না কেন।

আরও একটা কথা ভয়ে বলি না নির্ভয়ে বলি, আমরা দলিত রাষ্ট্রপতি আগেও পেয়েছি। নারীও রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছেন। তবু আজও কেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলিত সমাজের মানুষের প্রতি অকথ্য নির্যাতনের খবর পাওয়া যায়? আর দেশের নারীসমাজ আজ যে লাঞ্ছনা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে চলেছে, তাতে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়।

আমাদের স্বাধীনতার সত্তর বছর পূর্তি উৎসব হতে চলেছে, ভারত দাঁড়িয়ে এক সন্ধিক্ষণে। যে উদার মুক্তমনা স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন মহাত্মা গাঁধী ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু-র মতো স্বাধীনতা সংগ্রামীরা আমাদের দেখিয়েছেন, তা রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। আমাদের সংবিধানের প্রণেতা বাবাসাহেব অম্বেডকর এক জন প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি। তাঁকে আমরা মনে রেখেছি তাঁর কৃতিত্বের জন্য। তিনি আজীবন দলিতদের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন আর ভারতকে দিয়েছেন সকল সহযোগীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর এক অসামান্য সংবিধান। সমান অধিকারের এই প্রবক্তা আজকের দিনের দলিতদের নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির ‘টোকেন-ইজম’-এর রাজনীতি বরদাস্ত করতেন বলে মনে হয় না।

আমার দিল্লির বহুতল আবাসের বারান্দা থেকে চোখে পড়ে অদূরে রাষ্ট্রপতি ভবনের গম্বুজ। একটু পাশে চোখ ফেরালে দুটি সুউচ্চ অট্টালিকা: সাউথ ব্লক, নর্থ ব্লক। পাশেই গোলাকৃতি পার্লামেন্ট ভবন। দিগন্তের এই ক্ষুদ্র পরিসরে দৃশ্যমান গৃহ থেকে ভারতের ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয়। গম্বুজওয়ালা বাড়িটিতে যিনি বাসিন্দা হবেন, তাঁর হাতে বেশি ক্ষমতা নেই। তবু আশা করব, প্রয়োজনে তিনি সুচিন্তিত ভাবে সেই স্বল্প ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন, সংবিধানের ‘স্পিরিট’ রক্ষা করবেন। যে দল থেকেই তাঁর নাম প্রস্তাবিত হয়ে থাক, তিনি মনে রাখবেন দলের ঊর্ধ্বে দেশ। এক ঐক্যবদ্ধ মুক্তমনা ভারতের আদর্শ থেকে তিনি বিচ্যুত হবেন না।

আমার বারান্দার চেয়ার থেকে চোখ তুলে দেখি গ্রীষ্মের তাপদগ্ধ রাষ্ট্রপতি ভবনের গম্বুজের ওপর ঝিরিঝিরি ধারায় বৃষ্টি পড়ছে।

ভূতপূর্ব সদস্য, লোকসভা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন