—প্রতীকী ছবি।
অস্পৃশ্য— ভারতীয় সমাজে এক জন ধর্ষিতার পরিচয় ইহার অধিক কিছু নহে। পর্যবেক্ষণটি সর্বোচ্চ আদালতের। ধর্ষিতার পরিচয় প্রকাশ সংক্রান্ত বিষয়ে এক মামলার প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট এ হেন পর্যবেক্ষণটি তুলিয়া ধরিয়াছে এবং ভারতীয় সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিকে স্মরণে রাখিয়া রায় দিয়াছে, কোনও অবস্থাতেই ধর্ষিতার পরিচয় প্রকাশ করা যাইবে না। তিনি মৃত বা অপ্রকৃতিস্থ হইলেও অথবা তাঁহার অভিভাবকেরা পরিচয় প্রকাশে সম্মত থাকিলেও তাহা গোপন রাখিতে হইবে। নাবালিকাদের ক্ষেত্রে ইহা বিশেষ ভাবে প্রযোজ্য। সতর্ক করা হইয়াছে পুলিশকে, যাহাতে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের এফআইআর দায়ের করিবার সময় সচেতন ভাবে নামটি গোপন রাখা হয়। এবং সঙ্গে এই স্পর্শকাতর বিষয়গুলিকে নাড়াচাড়া করিবার সময় প্রচারমাধ্যমের দায়িত্বের কথাটিও স্মরণ করাইয়া দেওয়া হইয়াছে।
রায়টি গুরুতর। যে কোনও দেশেই ধর্ষিতার অধিকারের গুরুত্ব আছে। কিন্তু ভারতীয় সমাজে এই গুরুত্ব কয়েক গুণ বেশি। কারণ, পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক কাঠামোর মধ্যে ক্ষমতার প্রশ্নে লিঙ্গবৈষম্য এবং শ্রেণিবৈষম্য এই দেশে এতটাই প্রবল যে, নির্যাতিতার সুবিচারের সম্ভাবনা নিতান্তই স্বল্প। শহরাঞ্চলের আলোকপ্রাপ্ত সমাজে সুবিচার তবু মিলিতে পারে, কিন্তু সেই সমাজের বাহিরে প্রান্তিক, দলিত বা সংখ্যালঘু মেয়ের অভিযোগকে ক্ষমতা এবং অর্থের জোরে চুপ করাইয়া দেওয়া হয়। কাঠুয়া গণধর্ষণের মামলাটি ইহার মোক্ষম উদাহরণ। নির্যাতিত শিশুর নাম-পরিচয় প্রকাশিত হইবার সঙ্গে সঙ্গেই অপরাধীকে আড়াল করিবার এক প্রচণ্ড রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রয়াস সেখানে শুরু হইয়াছিল। তাই নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু তদন্তকার্যের জন্যই এই দেশে ধর্ষণ-সংক্রান্ত তথ্যাদি গোপন রাখা শ্রেয়।
গোপন রাখিবার প্রয়োজনটি নারীর প্রতি ভারতীয় সমাজের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গিটি বিচার করিলেও বোঝা যায়। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে ধর্ষিতা অপরাধের শিকার নহে, অপরাধের ‘কারণ’। এই দেশে নির্যাতিতার চরিত্র, অপরাধকালে তাহার পোশাক, বাড়ি ফিরিবার সময় জানিবার দরকার ঘটে। প্রশ্ন ওঠে, সমাজ নির্দেশিত আচরণবিধি হইতে মেয়েটির কোনও ‘স্খলন’ ঘটে নাই তো? যেন ‘স্খলন’-এর প্রমাণ মিলিলেই অপরাধটি না-অপরাধ হইয়া যায়। সমাজ যদি অপরাধকে এমন চক্ষে বিচার করে, তবে গোপনীয়তা জরুরি বইকি। পরিচয় প্রকাশ না পাইলে যদি নির্যাতিতার এক সম্মানজনক বিবাহ হয়, শ্বশুরঘর তাহাকে তাড়াইয়া না দেয়, কর্মক্ষেত্রে লাঞ্ছনা ভোগ করিতে না হয় এবং ধর্ষণ-পরবর্তী সামাজিক অস্পৃশ্যতার হাত হইতে রেহাই মিলে— তাহাই বিধেয়। অসম্মানের যন্ত্রণা শুধুমাত্র তো নির্যাতিতাকে ভোগ করিতে হয় না, পরিবারটিকেও সমাজ একঘরে করিয়া ছাড়ে। এই পরিণতির কথা ভাবিয়া নির্যাতিতার নিজ পরিবারই ক্ষেত্রবিশেষে তাহাকে পরিত্যাগ করে। শারীরিক ও মানসিক উভয় ক্ষেত্রেই বিপর্যস্ত মেয়েটির স্বাভাবিকতায় ফিরিবার আর কোনও উপায়ই থাকে না। নির্যাতিতাকে স্বাভাবিকতায় ফিরাইতে হইলে গোপনীয়তা ছাড়া পথ নাই।