নৈতিকতার সীমা

শ্রীযুক্ত ধনখড় আপন রাজ্যপাল পদটির মর্যাদা সম্যক জানেন কি না, সেই অপ্রিয় প্রশ্নটিও এড়ানো যাইবে না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:১০
Share:

—ফাইল চিত্র।

রাজভবনে অধিষ্ঠিত হইবার কিছু দিন পরে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বৈঠক ডাকিয়া জানিতে চাহিয়াছিলেন, আচার্যের কর্তব্য সম্পর্কে তাঁহাদের অভিমত কী। আচার্য তাঁহার কর্তব্যের পরিধি লইয়া বিচার করিতে উৎসাহী, ইহা ভাল কথা। কিন্তু বৃহস্পতিবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁহার ভূমিকা বিচারশীল শুভবুদ্ধির পরিচয় দেয় নাই। সে দিন সন্ধ্যায় রাজ্যবাসী বিস্মিত হইয়া দেখিল, সংবিধান যাঁহাকে দৈনন্দিন প্রশাসনের বহু ঊর্ধ্বে এক মর্যাদার আসনে বসাইয়াছে তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা শাসক দলের সাংসদকে ‘উদ্ধার’ করিবার জন্য দৌড়াদৌড়ি করিতেছেন। সুপ্রিম কোর্টের ভূতপূর্ব আইনজীবী শ্রীযুক্ত ধনখড় বলিতেই পারেন, তিনি আচার্য, বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কোনও সময় প্রবেশের অধিকার তাঁহার আছে। কিন্তু তাঁহার আইনি অধিকার লইয়া কেহ প্রশ্ন তুলিতেছে না। প্রশ্ন নৈতিকতার। বৈঠকে সমবেত উপাচার্যরা তাঁহাকে বলিয়া থাকুন বা না থাকুন, এই প্রাথমিক কথাটি তাঁহার না জানিবার কোনও কারণ নাই যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের পদটি নিতান্তই আলঙ্কারিক। নির্ধারিত কিছু আচার অনুষ্ঠানের বাহিরে তাঁহার কোনও সক্রিয় ভূমিকা নাই, থাকা উচিতও নহে। বস্তুত, নিষ্ক্রিয়তার নিষ্ঠাবান উদ্‌যাপনেই এই ধরনের পদের সম্মান নিহিত থাকে। বিশেষত, রাজ্যপাল বা প্রধানমন্ত্রীরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য, তখন সেই আনুষ্ঠানিকতার গুরুত্ব আরও বেশি, কারণ ওই প্রশাসনিক পদটি ভিন্ন আচার্য-সত্তার দ্বিতীয় কোনও উৎস নাই।

Advertisement

শ্রীযুক্ত ধনখড় আপন রাজ্যপাল পদটির মর্যাদা সম্যক জানেন কি না, সেই অপ্রিয় প্রশ্নটিও এড়ানো যাইবে না। ভারতের সংবিধান রাজ্যপালের কর্তব্যের পরিধি নির্দিষ্ট করিয়াছে। রাজ্য প্রশাসনের আনুষ্ঠানিক প্রধান এবং কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে সাংবিধানিক যোগসূত্রের ধারক হিসাবে বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রাপ্ত দলকে সরকার গড়িতে আহ্বান করা, সংবিধানের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের কাজের পর্যালোচনা, বিশেষ প্রয়োজনে মুখ্যমন্ত্রীকে পরামর্শ ও মতামত প্রদান, বিধানসভায় নির্ধারিত উপলক্ষে ভাষণ দান ইত্যাদি কয়েকটি কাজের মধ্যেই তাঁহার কর্তব্য সীমাবদ্ধ। এবং সেই কর্তব্যগুলিও তিনি সাধারণ ভাবে নির্বাচিত রাজ্য সরকারের পরামর্শ অনুসারে পালন করিবেন, ইহাই প্রত্যাশিত। এই সংযম, আবারও, আইনের বিধান নহে, নৈতিকতার শর্ত। বৃহস্পতিবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁহার অভিযান সেই শর্ত লঙ্ঘন করিয়াছে, এমনকি এই বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীর উপর্যুপরি অনুরোধকেও তিনি মান্যতা দেন নাই। রাজ্যপালের আসনে বসিয়া স্বাভাবিক কর্মপরিধির বাহিরে গিয়া অতিসক্রিয় হইবার নজির পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিস্তর দেখা গিয়াছে। রাজ্যপালের পদটিকে কেন্দ্রীয় শাসক দলের রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহারের অভিজ্ঞতাও পরিচিত। শ্রীযুক্ত ধনখড় পশ্চিমবঙ্গের রাজভবনে নবাগত। এই অবধি তাঁহার অতিসক্রিয়তার প্রকট কোনও নমুনা দেখা যায় নাই, অন্তত তাহা বাহিরে আসে নাই। কিন্তু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাবুল সুপ্রিয় ঘটিত কাণ্ডে তাঁহার কর্মযোগের মূর্তি জনসমক্ষে প্রকাশ পাইল। সেই মূর্তি সুস্থ, সংযত, নৈতিকতার অনুশীলন সম্পর্কে ভরসা দিল না। দুর্ভাগ্য পশ্চিমবঙ্গের। দুর্ভাগ্য তাহার রাজভবনের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন