মার্জারের ধন

সর্বাধিক দুঃখের ব্যাপার হইল, পোষ্যটির যে হেতু অর্থলোভ নাই, সে যে হেতু অর্থকে সুখের চাবিকাঠি বলিয়া ধরে না, তাই এই বিপুল সম্পত্তির প্রাপ্তিতে তাহার চিত্তে ন্যূনতম তরঙ্গও উঠে না। যদি ধরিয়া লওয়াও হয়, ইহার পর হইতে তাহাকে প্লাটিনাম-পালঙ্কে নিদ্রা যাইবার বন্দোবস্ত করিয়া দেওয়া হইল, সে তথাপি ডাস্টবিন ঘাঁটিয়া খাইতে ও পাঁচিলে বসিয়া ঢুলিতে পছন্দ করিতে পারে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০১৯ ২৩:৫৬
Share:

‘চুপেট’— প্রয়াত ফ্যাশন ডিজ়াইনার কার্ল লাগারফেল্ডের আদরের পোষ্য এই বার্মিজ় বেড়াল। ছবি: এএফপি।

বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজ়াইনার কার্ল লাগারফেল্ড মারা যাইলেন সম্প্রতি, তাঁহার ১৯২ মিলিয়ন ডলারের সম্পত্তির বেশ কিছু অংশ পাইবে তাঁহার পোষা বিড়াল শুপেত। শুপেত ইহার পূর্বে একটি প্রসাধন সংস্থা ও একটি গাড়ি নির্মাতা সংস্থার বিজ্ঞাপন করিয়া বৎসরে তিন মিলিয়ন ডলার উপার্জন করিয়াছিল, ফলে ধনসম্পদ তাহার নিকট অচেনা নহে, কিন্তু এই বার যে পরিমাণ টাকা সে পাইবে, তাহা বোধ হয় চূড়ান্ত মার্জারস্বপ্নেও দেখে নাই। ইহা খুব অভিনব ঘটনা নহে, অনেক প্রবল ধনী মানুষ উত্তরাধিকারী হিসাবে পোষ্যের নামে উইল করিয়া যান। তাঁহাদের খামখেয়ালি বলিয়া অভিহিত করিবার প্রবণতা অনেকের থাকিতে পারে, কিন্তু পোষ্যকে প্রায় সকলেই সন্তানের সমানই দেখিয়া থাকেন (সন্তান বহু সময় পিতামাতাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়া বাহির করিয়া দিলেও পোষ্য কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করে না)। তাই তাহাকে সম্পত্তি অর্পণ করিবার মধ্যে উদ্ভট কিছুই নাই। ইহার পূর্বে বেশ কিছু কুকুর ও বিড়াল তো বটেই, টিয়াপাখি, ভল্লুক, শিম্পাঞ্জি বা মুরগিও এই ভাবে প্রবল সম্পদের অধিকারী হইয়াছে। মুশকিল হইল, এই অর্থ লইয়া পোষ্য তো আর নিজের খাদ্য, ক্রীড়াদ্রব্য, শয্যা, লোম আঁচড়াইবার স্বর্ণ-কঙ্কতিকা কিনিয়া আনিতে পারিবে না, নিজ যত্নও লইতে পারিবে না, তাই তাহার দায়িত্ব প্রদান করা হয় কোনও ব্যক্তিকে। সেই ব্যক্তিটির সৌভাগ্যের কথা ভাবিয়া অবশ্যই বহু মানুষ হিংসাজর্জর হইয়া পড়েন। কারণ কোটি কোটি টাকা লইয়া তিনি পূর্ণ অঙ্কটিই পোষ্যটির খাতিরে খরচ করিতেছেন কি না, ইহার হিসাব রাখিবার ক্ষমতা বিড়াল বা কুকুরের সাধারণত থাকে না। এমনকি পোষ্যটিকে না খাইতে দিয়া, প্রহার করিয়া, চূড়ান্ত হতশ্রদ্ধা করিলেও সে মামলা করিতে পারিবে না। তাই সম্পত্তিটি বকলমে পোষ্যের তত্ত্বাবধায়কই পাইয়া যাইলেন কি না, ইহা লইয়া নিন্দুকেরা প্রবল মস্তক আন্দোলন করেন।

Advertisement

সর্বাধিক দুঃখের ব্যাপার হইল, পোষ্যটির যে হেতু অর্থলোভ নাই, সে যে হেতু অর্থকে সুখের চাবিকাঠি বলিয়া ধরে না, তাই এই বিপুল সম্পত্তির প্রাপ্তিতে তাহার চিত্তে ন্যূনতম তরঙ্গও উঠে না। যদি ধরিয়া লওয়াও হয়, ইহার পর হইতে তাহাকে প্লাটিনাম-পালঙ্কে নিদ্রা যাইবার বন্দোবস্ত করিয়া দেওয়া হইল, সে তথাপি ডাস্টবিন ঘাঁটিয়া খাইতে ও পাঁচিলে বসিয়া ঢুলিতে পছন্দ করিতে পারে। যে জীবটির অর্থ সম্পর্কে বোধ নাই (বা, বলা যাইতে পারে, অর্থকে অগ্রাহ্য করিয়া বাঁচিবার অলীক সারল্য যাহার জন্মগত) তাহাকে বিপুল অর্থ দিয়া যাইবার মধ্যে সম্পত্তিদাতার নিজ মানসিক শান্তি ব্যতীত কিছুই নিহিত নাই। বিশ্বের সর্বাধিক ধনী কুকুরের সম্পত্তি প্রথমে ছিল ৬৫ মিলিয়ন ডলার, উহার পর এই সম্পত্তির দায়িত্ব যাঁহারা পাইয়াছিলেন, তাঁহারা ইহাকে বাড়াইয়া ৩৭৫ মিলিয়ন ডলারে লইয়া যান, যাহা পাইয়াছে ওই কুকুরের সন্তান। কিন্তু বংশপরম্পরায় তাহারা ইহা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অচেতন থাকিল। হয়তো সেই জন্যই যখন ২০০৭ সালে এক প্রবল ধনী মহিলা তাঁহার পোষ্য কুকুরকে ১২ মিলিয়ন ডলার উইল করিয়া দিয়া গিয়াছিলেন, আদালতের এক বিচারক প্রাপ্য অর্থের অঙ্ক কমাইয়া ২ মিলিয়ন করিয়া দেন, কারণ একটি কুকুরকে চরম যত্নে রাখিতে ওই অর্থই যথেষ্ট বলিয়া তিনি মনে করিয়াছিলেন।

ঘটনাগুলির নেপথ্যে একাকিত্বের কথাও কেহ তুলিতে পারেন। প্রকাণ্ড ধনী মানুষ তাহা হইলে এমন প্রবল একা হইতে পারেন, তাঁহার কোনও বন্ধু বা আত্মীয়কে তিনি প্রিয়জন না মনে করিয়া, সম্পত্তি না দিয়া, এক মনুষ্যেতর প্রাণীকে দিয়া যাইতেছেন। কেহ বলিবেন, হয়তো ধনসম্পদ তাঁহাকে মানুষ চিনিতে সাহায্য করিয়াছে এবং এই উপলব্ধিতে উপনীত করিয়াছে যে মানুষই হইল সর্বাধিক ইতর জন্তু, তাই মানুষ অপেক্ষা অবোধ একটি জীবকে সাহায্য করিবার প্রয়াস অধিক বিচক্ষণ। কেহ বলিতে পারেন, বিশ্ব জুড়িয়া এত মানুষ না খাইতে পাইয়া মরিতেছে, সেখানে একটি পোষ্যের জন্য এত অর্থ রাখিয়া যাইবার মধ্যে চূড়ান্ত স্বার্থপর ও সমাজ-অজ্ঞ মানসিকতার পরিচয় মিলে। এই অর্থগৃধ্নুরা জীবনে ও মরণে সহ-মানুষদের বঞ্চিত করিয়া বিকৃত আনন্দ ভোগ করিয়া থাকেন। কেহ বলিতে পারেন, অবলা পোষ্যটিকে যদি কেহ প্রাণাধিক ভালবাসেন, নিজ মৃত্যুর পরে তাহার যথাযথ যত্নের বন্দোবস্ত করিতে কোনও এক মানুষকে অর্থের লোভ দেখাইবার পদ্ধতি ব্যতীত আর কী-ই বা তাঁহার হাতে পড়িয়া অাছে? কোনও বাংলা ব্যান্ড ‘হায় কেন বিড়াল হইলাম না’ গান বাঁধিলেই এই মহাকাব্যের ষোলো কলা পূর্ণ হয়।

Advertisement

যৎকিঞ্চিৎ

ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট দুতের্তে বললেন, শিশুদের শাসন করতে গিয়ে মারধর উচিত নয়— পাশ্চাত্যে এমন ভাবনার চল আছে, কিন্তু সেই ধারণাকে প্রতিহত করতে হবে। নিশ্চয়ই ভারতেও কেউ কেউ তীব্র সমর্থন জানাবেন, ছোট ছেলেমেয়েদের কিলিয়ে কাঁঠাল পাকিয়ে অঙ্ক কষাতে অনেকেই উৎসাহী। তা ছাড়া সন্তানের জন্ম দেওয়ার মানেই বা কী, নিজের হতাশা ও রাগঝাল যদি তার পিঠে উগরে দিতে না পারলাম। সেই শিশু বড় হয়ে গুরুজনদের অশ্রদ্ধা করলে দুতের্তে কী বলবেন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন