পতাকার ভার

সাম্প্রতিক জাতীয়তাবাদী উদ্বেগের আতিশয্য সেই বিতর্ককে ইন্ধন জোগাইতেছে। প্রশ্ন বহু প্রকার। প্রথম প্রশ্ন, ইহার সহিত রাজ্যের নিজস্ব আত্মপরিচয়ের দাবিটি কতটা জড়িত। কিংবা এই পতাকার মধ্যে কি দ্রাবিড় আবেগেরই প্রকাশ? যদি তাহাই হয়, সে ক্ষেত্রে বিজেপির দৃষ্টিকোণমতে ইহা নিশ্চিত ভাবে ‘জাতীয়তাবিরোধিতা’, ‘দেশদ্রোহিতা’!

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০১৭ ০০:০০
Share:

কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া।- ফাইল চিত্র।

ক র্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়ার পতাকা-সংক্রান্ত প্রস্তাবটি একসঙ্গে অনেকগুলি সমস্যার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছে। তিনি জানাইয়াছেন, রাজ্যের জন্য একটি আলাদা পতাকা রাখা কত দূর সংবিধানসম্মত, তাহা খতাইয়া দেখিবেন। কন্নড় সমাজ তাঁহার আশ্বাসে উৎফুল্ল। সাংবিধানিক সম্মতির অপেক্ষা না করিয়াই তাঁহারা রাজ্যের নামে একটি বিশেষ পতাকা উড়াইয়া আসিতেছেন, গত কিছু কাল যাবৎ নানা কারণে সেই পতাকা-প্রিয়তা অনেক গুণ বাড়িতেও দেখা গিয়াছে। গত সপ্তাহে বেঙ্গালুরুর হিন্দিবিরোধী আন্দোলনের সহিতও কর্নাটকের এই নিজস্ব পতাকাটি উত্তম রূপে মিশিয়াছে। সব মিলাইয়া বিতর্ক দানা বাঁধিতে বাকি নাই। সাম্প্রতিক জাতীয়তাবাদী উদ্বেগের আতিশয্য সেই বিতর্ককে ইন্ধন জোগাইতেছে। প্রশ্ন বহু প্রকার। প্রথম প্রশ্ন, ইহার সহিত রাজ্যের নিজস্ব আত্মপরিচয়ের দাবিটি কতটা জড়িত। কিংবা এই পতাকার মধ্যে কি দ্রাবিড় আবেগেরই প্রকাশ? যদি তাহাই হয়, সে ক্ষেত্রে বিজেপির দৃষ্টিকোণমতে ইহা নিশ্চিত ভাবে ‘জাতীয়তাবিরোধিতা’, ‘দেশদ্রোহিতা’! দেশের প্রতি বিশ্বস্ততা অটুট হইলে রাজ্যের পতাকার প্রতি আবেগ কোথা হইতে জন্ম লয়? অর্থাৎ রাজ্য-কেন্দ্র, আর্যাবর্ত-দাক্ষিণাত্য, হিন্দি-কন্নড়, কন্নড়-তামিল, সব রকম সাংস্কৃতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংঘর্ষ পতাকাকে উপলক্ষ করিয়া উঠিয়া আসিয়াছে।

Advertisement

একটি কথা গোড়াতেই স্পষ্ট হওয়া দরকার। সেই স্বাধীনতা-পূর্ব কাল হইতে কন্নড় পতাকার ঐতিহ্যটি কিন্তু বহুশ্রুত। প্রখ্যাত কন্নড় কবি ও সাহিত্যিক বি এম শ্রীকান্তাইয়া ১৯২৬ সালে পতাকা-বন্দনার কবিতা লিখিয়াছিলেন। সেই কবিতায় কিন্তু কোনও জাতীয় পতাকার কথা ছিল না, আ়ঞ্চলিক পতাকাই বন্দিত হইয়াছিল। সেই সময় হইতেই কন্নড় অঞ্চলগুলির ঐক্যসাধনের কথা বলিয়া আসিতেছেন আঞ্চলিক নেতারা, এবং পতাকার জনপ্রিয়তাও ধারাবাহিক ভাবে বজায় থাকিয়াছে। স্বাধীনতার দশক ও তাহার অব্যবহিত পরবর্তী সময়ে খানিক স্তিমিত থাকিবার পর আবার এই কন্নড় জাতীয়তাবাদ ভাল ভাবেই আত্মপ্রকাশ করে উনিশশো পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে, কন্নড়-তামিল টক্করের সূত্রে। ইহার প্রেক্ষিত হিসাবে মনে রাখিতে হইবে স্বাধীনতা-পরবর্তী তামিল ভাষার দাবি-আন্দোলনটিকে। মনে রাখিতে হইবে, সাংস্কৃতিক সত্তাপরিচয়ের দাবি কখনও একক ভাবে আসে না, পাশাপাশি অন্যান্য সত্তাগুলিকেই তাহা উদ্বেলিত ও উজ্জীবিত করে। কন্নড়-তামিল প্রতিযোগিতা তাহার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কন্নড় পতাকাটিকেও সেই ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতেই বুঝিতে হইবে।

তেমন ভাবে ভাবিলেই বোঝা সম্ভব, কন্নড় পতাকার মধ্যে কোনও রাষ্ট্রবিরোধিতা তো দূরস্থান, সত্যিকারের কোনও সংস্কৃতি-বিরোধিতাও নাই। কন্নড় আইডেন্টিটিকে প্রাণিত করিবার অর্থই ভারতীয় আইডেন্টিটিকে ক্ষুদ্র করা, এমন ভাবে যাঁহারা ভাবেন, সংকীর্ণতা তাঁহাদের ভাবনাতেই। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ঠিক এই বক্তব্য প্রতিফলিত হইয়াছিল যে, কোনও রাজ্যের নিজস্ব পতাকা থাকিতেই পারে, অসুবিধা নাই, তবে তাহার স্থান হইবে জাতীয় পতাকার নিম্নে। রাজ্যের সরকার ও অধিবাসীগণ যদি এই মূল নীতি মানিয়া আঞ্চলিক পতাকা ব্যবহার করেন, আপত্তির অবকাশ থাকিতে পারে না। তবে, সুবিবেচনা জরুরি। কোন ক্ষেত্রে জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় পতাকাটির অগ্রাধিকার, ভুলিয়া গেলে চলিবে না। ইহাও ভোলা যাইবে না যে, জাতীয়তাবাদ আসলে একটিমাত্র একক নয়, বরং বহু ধরনের সমান্তরাল সত্তাবোধের প্রকাশ, সেই বহুকে পাশাপাশি স্থান না দিলে একবিংশ শতকের জাতীয়তা বাস্তবের পরীক্ষায় পাশ করিবে না। কর্নাটকের পতাকা-বিতর্ক এই গুরুতর কথাটি আর এক বার মনে করাইয়া দিল।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন