সম্পাদকীয় ১

কোন অতলে

স্কুলছুট তরুণ নহে, মহম্মদ রফি বাট কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্বের সহকারী অধ্যাপক ছিল। দুঃসহ আঠারো বৎসর নহে, তাহার বয়স হইয়াছিল ৩৩। মহম্মদ রফি বাট বিবাহিত ছিল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৮ ০৬:০৪
Share:

স্কুলছুট তরুণ নহে, মহম্মদ রফি বাট কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্বের সহকারী অধ্যাপক ছিল। দুঃসহ আঠারো বৎসর নহে, তাহার বয়স হইয়াছিল ৩৩। মহম্মদ রফি বাট বিবাহিত ছিল। কাশ্মীরের জঙ্গি বলিতে যে ছবিটি চোখে ভাসিয়া উঠে, বাটের সহিত তাহার দূরত্ব বিস্তর। তবুও, প্রতিষ্ঠিত সংসারী জীবন ছাড়িয়া জঙ্গি দলে নাম লিখাইয়াছিল বাট। তবে, সে বিরল ব্যতিক্রম নহে। গত এক বৎসরে কাশ্মীরে এমবিএ, ইঞ্জিনিয়ার বা ডক্টরেট ডিগ্রিধারী বেশ কয়েক জন সন্ত্রাসবাদের পথই বাছিয়া লইয়াছে। বাটের জঙ্গিজীবন দীর্ঘস্থায়ী হয় নাই। মাত্র দুই দিনের মধ্যেই সশস্ত্র বাহিনীর গুলিতে নিহত হইল সে। কিন্তু, তাহার মৃত্যু বেশ কয়েকটি অমীমাংসিত প্রশ্ন রাখিয়া গেল। প্রথম প্রশ্ন, কাশ্মীরের সমস্যার কারণ যদি মূলত অর্থনৈতিকই হয়, তবে বাটের ন্যায় সুপ্রতিষ্ঠিত যুবক কেন জঙ্গি দলে নাম লিখাইবে? ওমর আবদুল্লা প্রশ্নটি উপত্যকার রাজনৈতিক হাওয়ায় ভাসাইয়া দিয়াছেন। দ্বিতীয় প্রশ্ন, গত দুই বৎসরে কেন্দ্রীয় সরকার যে ভঙ্গিতে কাশ্মীরের উগ্র রাজনীতিকে দমন করিতেছে, সাম্প্রতিক অতীতে তাহা দেখা যায় নাই। বুরহান ওয়ানির সহিত যে দশ জন জঙ্গির ছবি ২০১৬ সালে কাশ্মীরি উগ্রপন্থার প্রতীক হইয়া উঠিয়াছিল, এক জন বাদে তাহাদের প্রত্যেকেই নিহত। ২০১৭ হইতে আজ অবধি ২৮০ জনেরও অধিক জঙ্গি নিহত। সেই সামরিক সক্রিয়তাও কেন উগ্রপন্থাকে ঠেকাইতে পারিতেছে না? কেন জঙ্গি দলে নাম লিখাইবার প্রবণতাটি ক্রমবর্ধমান?

Advertisement

প্রশ্নগুলির উত্তরও অজানা নহে। কাশ্মীরের সমস্যা মূলত রাজনৈতিক, এবং রাজনৈতিক সমাধান ভিন্ন উপত্যকা শান্ত হইবে না। কথাটি ভারতীয় সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়তও দৃশ্যত জানেন। এপ্রিলে তিনি বলিয়াছিলেন, জঙ্গি অথবা সামরিক বাহিনী, কোনও পক্ষই এই পথে নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছাইতে পারিবে না। তাহার জন্য শান্তিপূর্ণ আলোচনা প্রয়োজন। সমস্যা হইল, কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করিয়া আলোচনায় বসিবার কাজটি উগ্র জাতীয়তাবাদীদের চক্ষে কাপুরুষতা ঠেকিবে। ছাপ্পান্ন ইঞ্চির ছাতি থাকিলে পিটাইয়া শায়েস্তা করিয়া দেওয়াই দস্তুর। তাহার উপর আবার উগ্রপন্থীরা মুসলমান। অতএব, সরকার তাহাদের প্রতি ‘নরম’ হইলে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষে তাহা মানিয়া লওয়া কঠিন। বিজেপি তাহার রাজনীতিকে এই দুই গোত্রের উগ্রতার উপর প্রতিষ্ঠা করিয়াছে। যে সরকার ‘সিয়াচেনের সৈনিক’দের রূপকটিকে আত্মস্থ করিয়া লইয়াছে, এবং দেশের সামরিক শক্তির সহিত নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্বকে অদ্বৈতে প্রতিষ্ঠা করিয়াছে, তাহাদের সেই প্রবল পৌরুষের পক্ষে কি আলোচনার নমনীয়তা স্বীকার করা সম্ভব? ফলে, কাশ্মীর ক্রমেই আরও অশান্ত হইতেছে।

তাহাতে বিপুল ক্ষতি কাশ্মীরের গণতান্ত্রিক রাজনীতির কুশীলবদের। ভারত নামক রাষ্ট্রের সাংবিধানিক অধীনতা স্বীকার করিয়া তাঁহাদের রাজনীতি করিতে হয়। তদুপরি সেই রাজনীতি যদি একান্তই ফলপ্রসূ না হয়, মানুষ যদি জানে যে রাষ্ট্রের নিকট কোনও দাবি পেশ করিতে গেলে পাথর অথবা গ্রেনেডই ভরসা, তবে সংসদীয় রাজনীতির বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে কোথায়? মেহবুবা মুফতি নিশ্চয় কথাটি টের পাইতেছেন। তাঁহার পক্ষে পরিস্থিতি আরও জটিল, কারণ রাজ্যে তাঁহার সরকারের শরিক বিজেপি। অর্থাৎ, তিনি দৃশ্যত তাঁহার সহযোগী দলকেই উপত্যকায় শান্তি আলোচনায় রাজি করাইতে ব্যর্থ। এই ক্ষতি শুধু জনৈক মেহবুবা মুফতি বা ওমর আবদুল্লার নহে। ক্ষতিটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার। সংসদীয় রাজনীতির এই ব্যর্থতায় কাশ্মীর যদি ক্রমে আরও উগ্রপন্থার পথে হাঁটে, সেই পরিস্থিতি সামলাইবার সাধ্য কোনও ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতিরও থাকিবে না বলিয়াই আশঙ্কা হয়।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement