এমন গল্প ক’টাই বা তৈরি হয়

গল্পটা এ ভাবেও বলা যেতে পারে— আলো ফোটার আগেই সে-দিন আজাদ ময়দান থিকথিক করছিল ভিড়ে। অথচ কোথাও কোনও অশান্তি নেই, বাড়তি চেঁচামেচি নেই।

Advertisement

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০১৮ ০০:১৭
Share:

চোখের সামনে একটা গল্প তৈরি হতে দেখলাম মনে হল। ১২ মার্চ, ২০১৮। গল্পটা এ ভাবে শুরু হতে পারে: সরকার বলেছিল সোমবার সকালে শহরে ঢোকা যাবে না। রবিবার মাঝরাত থেকে মিছিলটা তাই আবার চলতে শুরু করেছিল। মিছিল তো নয়, ৩৫ হাজার মানুষের স্রোত একটা। মুম্বইয়ের বহু লোক সে-দিন ঘুমোয়নি। ওই রাতেই রাস্তার মোড়ে মোড়ে তারা অপেক্ষা করেছে। কড়া পড়ে যাওয়া মেহনতি হাতগুলোর দিকে বাড়িয়ে ধরেছে জলের বোতল, বিস্কুটের প্যাকেট।

Advertisement

গল্পটা এ ভাবেও বলা যেতে পারে— আলো ফোটার আগেই সে-দিন আজাদ ময়দান থিকথিক করছিল ভিড়ে। অথচ কোথাও কোনও অশান্তি নেই, বাড়তি চেঁচামেচি নেই। ডাব্বাওয়ালারা নিজেরাই ঠিক করেছিলেন, চাষিদের জন্য খাবার নিয়ে আসবেন। কেউ হুকুম করেনি। ওঁরা নিজেরাই মনে করেছিলেন, এ ওঁদের কর্তব্য। বেলা বাড়লে কিছু সাংবাদিক মিলে সোশ্যাল মিডিয়ায় হাঁক দিলেন, ‘লোয়ার পারেলে হাওয়াই চটি সংগ্রহ করা হচ্ছে। নতুনই দেবেন কিন্তু, ছেঁড়া দেবেন না!’

যে ভাবেই বলুন না কেন, গল্পটা গল্পের মতো হয়ে উঠছে আপনা থেকেই। কসরত করতে হচ্ছে না, রং চড়াতে হচ্ছে না। কয়েকটা রেখা টানলেই ছবি হয়ে যাচ্ছে। এমন মুহূর্ত কি বার বার আসে?

Advertisement

২০১৮-র ১২ মার্চ আসলে একটা গল্পের দিন। বলার মতো, মনে রাখার মতো, মনে করানোর মতো গল্প। এমন এক লোককথা, যা বাহিত হতে পারে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। তার পূর্ণ উপাদান এ কাহিনিতে মজুত। কল্পনা করতে দোষ নেই, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরে কেউ বলছেন, আমি ওই মিছিলে পা মিলিয়েছিলাম! কেউ বলছেন, আমি জলের বোতল এগিয়ে দিয়েছিলাম! কেউ বা জুড়ে দিচ্ছেন, ভূমিশয্যা থেকে সে-দিন নিশ্চয় অদৃশ্যে অভিবাদন জানিয়েছিলেন মহামতি।

এ ভাবেই তো বেঁচে থাকে গল্পেরা। যে রকম চিপকো, যে রকম পস্কো। যে রকম সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রাম। তফাত আছে গল্পগুলোয়। সব গল্প এক নয়, এক রকম নয়, এক মাপের বা মাত্রারও নয়। কিন্তু গল্প বটে সকলেই। চিপকো-পস্কো-সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম— এ সবই দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধের কাহিনি। তার পাশে ১২ মার্চ একটা কর্মসূচি। তার পিছনেও দীর্ঘ লড়াই আছে। দীর্ঘতর বঞ্চনার ইতিহাস আছে। কিন্তু ১২ মার্চের আখ্যানটুকু সেই উপন্যাসোপম বিস্তারের মধ্য থেকেও একটা অণু গল্প হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ছ’ছ’টা দিন ধরে ৩৫ হাজার মানুষ ঠা-ঠা রোদ মাথায় নিয়ে, নিজেরা রেঁধে খেয়ে, মাঠে ঘুমিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ১৮০ কিলোমিটার পার করে ফেলল, মুম্বইয়ের মতো একটা শহর তাদের জন্য হাত বাড়িয়ে দিল, সরকার হাওয়ার গতিক বুঝে তাদের দাবিদাওয়া অনেকাংশে মেনে নিল— এমন ম্যাজিক আর ক’টা গল্পে থাকে? পৃথিবীকে এক দিনের জন্যে হলেও মায়াময় দেখাবে, এমন গল্প ক’টাই বা হয়ে ওঠে?

গত চার দশকের খেরোর খাতা জুড়ে বীভৎস ক্ষত। ১৯৮৪, ১৯৯২, ২০০২ স্মরণে দগদগ করছে। আতঙ্কের চুড়ো হয়ে আছে ভোপাল-২৬/১১-ধনঞ্জয়-নির্ভয়া। পূর্বজরা কিন্তু শোনাতেন অন্য কাহিনি। বিভীষিকা কিছু কম দেখেননি তাঁরা। বরং বেশি। তবু তাঁদের জন্য আশা-ভরসা বাঁচিয়ে রাখার মতো গল্প ছিল অঢেল। ১২ মার্চ-কে তাঁরা জানতেন ডান্ডি অভিযানের সূচনাদিবস বলে। লং মার্চ মানে ছিল মাও জে দং আর তাঁর বাহিনীর প্রাণরক্ষার পথ। সে-সবের পাশে এই ১২ মার্চ মুহূর্তের রূপকথা মাত্র। কিন্তু এ ঊষর প্রান্তরেও যে রূপকথার জন্ম হয়, সেটাই কি নয় উদ্‌যাপনের জন্য যথেষ্ট? নিজস্বী-নিমগ্ন নগরসভ্যতা যে দু’চক্ষু কচলিয়ে ফুটিফাটা পাগুলোর দিকে তাকাল, সেটা কি নয় আলোকরেখা?

১২ মার্চের গল্প সত্যিই কোনও চেহারায় বেঁচে থাকবে কি না, কেউই জানি না এখনই। তথ্যের বিস্ফোরণ আর তাৎক্ষণিকতার প্রাবল্যে স্মৃতির পরিসর ক্রমক্ষীয়মাণ। কিন্তু গল্প হয়ে ওঠার গুণাবলি যে উপস্থিত ছিল, এই সত্য তাতে উবে যায় না। মার্কেজ তাঁর আত্মজীবনীর নাম দিয়েছিলেন, ‘লিভিং আ টেল টু টেল’! লেখক সবাই হন না ঠিকই। তবে নিজের যুগের গল্প নিজের মতো করে বলে যেতে চায় প্রায় সব মানুষই। দৃষ্টান্ত হয়ে থেকে যাওয়ার গল্প, ফিরে দেখার উপযোগী মুহূর্ত কমে আসছে দ্রুত। ১২ মার্চ ক্ষণিকের জন্য হলেও ভরসা দিল। ‘উদাসীন ঈশ্বর কেঁপে উঠবে না কি আমাদের পদাতিক পদক্ষেপে?’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন