চাপা চাপ ওড়াতে শহরে হা-হা হো-হো ‘ঔষধালয়’

হাসি মনের পক্ষে আরামের। মানসিক চাপ কাটাতে সহায়ক। তাই শহরগুলোয় শরীরচর্চার সঙ্গে চলে হাসি হাসি খেলা। কেমন সেই খেলা? খোঁজ নিলেন সৌমেশ্বর মণ্ডলহাসি মনের পক্ষে আরামের। মানসিক চাপ কাটাতে সহায়ক। তাই শহরগুলোয় শরীরচর্চার সঙ্গে চলে হাসি হাসি খেলা। কেমন সেই খেলা? খোঁজ নিলেন সৌমেশ্বর মণ্ডল

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৯ ১১:৪৫
Share:

প্রাণখোলা: মেদিনীপুর শহরের এক লাফিং ক্লাবে। নিজস্ব চিত্র

অপারেশন থিয়েটারের দরজা খুলে ঢুকে পড়েছিল মুন্নাভাই। সঙ্গে সার্কিট আর দলবল। অপারেশন টেবিলে ওঠা রোগীর তো বিস্ময়ে চোখ বেরিয়ে আসার মতো অবস্থা। কিন্তু ভীষণ ঠান্ডা মেডিক্যাল কলেজের ডিন ডক্টর আস্থানা। কারণ তিনি যে চাপ কমাতে হেসে ওঠেন। প্রথম কুঁকিয়ে। তার পর জোরে জোরে।

Advertisement

‘মুন্নাভাই এমবিবিএস’ সিনেমা তো এই সেদিনের। ২০০৩ সালের। কিন্তু মেদিনীপুরের পালবাড়িতে তার বহু বছর আগেই ‘হাস্য ঔষধালয়’ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। শহরে সেটাই প্রথম লাফিং ক্লাব। নতুনবাজারের বাসিন্দা ব্যাঙ্ককর্মী শিবনাথ দাস ১৯৯৬ সালে হাসির উপকার সম্পর্কে একটি লেখা পড়েছিলেন। পালবাড়িতে রামকৃষ্ণ মিশনের মাঠে প্রাতর্ভ্রমণের বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করেন। বিবিগঞ্জের বাসিন্দা বনবিহারী কর, সুকুমার রায় ও স্কুলবাজারের মিনু পাল এই উদ্যোগে সামিল হন। শুরু হয় হাসির অনুশীলন। গড়ে ওঠে বিবেকানন্দ লাফিং ক্লাব। সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। এরপর তাঁদের অনুশীলন সঠিক হচ্ছে কি না তা জানার জন্য বনবিহারী কর কলকাতায় এক লাফিং ক্লাবের প্রশিক্ষকের সঙ্গে কথা বলেন।

খড়্গপুর রেলশহরে একজন লাফিং ক্লাব চালাতেন। সুকুমার রায় খড়গপুরে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসেন। বনবিহারীবাবু ও সুকুমারবাবু বিবেকানন্দ লাফিং ক্লাবের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেন। কয়েক বছরের মধ্যেই মেদিনীপুর শহরে লাফিং ক্লাব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আগে প্রাতর্ভ্রমণকারীরা সদস্যরা লাফিং ক্লাবে আসতেন। ২০০৫ সালে প্রশিক্ষক দেবাশিস মণ্ডলের তত্ত্বাবধানে মেদিনীপুর শহরের জেলখানার মাঠে মাস্টার মর্নিং লাফিং ক্লাব ও সিস্টার্স লাফিং ক্লাব গড়ে ওঠে। মাতঙ্গিনী লাফিং ক্লাব চলছে কুইকোটার মাঠে। তেঁতুলতলার মাঠেও একটি লাফিং ক্লাব চলছে। ২০০৬ সালের ২৭ মার্চ থেকে মেদিনীপুর শহরের প্রাণকেন্দ্র বিদ্যাসাগর হল প্রাঙ্গণে প্রবীণাদের নিয়ে গড়ে ওঠে বিবেকানন্দ লাফিং ক্লাব ফর সিস্টার অ্যান্ড ব্রাদার্স’। এখন এখানে সদস্যা সংখ্যা ৭২ জন। এঁদের মধ্যে ৬০ জন মহিলা। প্রশিক্ষক সমীর দাস জানান, মেদিনীপুর শহরের ৫০ থেকে ৮০ বছরের বেশি মহিলারা এই ক্লাবে নিয়মিত আসছেন। ৭০-৮০ বছর বয়সেও তাঁরা দিব্বি সুস্থ আছেন।

Advertisement

কী ভাবে হয় এই লাফিং ক্লাস? সমীরবাবু জানালেন, চারটি ধাপে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ধাপে প্রাথমিক ভাবে ‘হা-হা হো-হো’ শব্দে হেসে ওয়ার্ম আপ করা হয়। তার পরে হাত উপর থেকে নীচে নামাতে নামাতে মুখ খুলে জোরে শব্দ করে হাসেন। তার পর চোখ বন্ধ করে ওম শব্দ করে মনোসংযোগ করা হয়। এরপর হা হা হো হো শব্দে আবার জোরে হাসা। দ্বিতীয় ধাপে মুখ বন্ধ রেখে জোরে হাসা হয়। তৃতীয় ধাপে হাত আকাশের দিকে তুলে নিঃশব্দে হাসি। শেষ ধাপে আকাশের দিকে হাত তুলে যে যার মতো হাসতে শুরু করেন। শেষ ধাপটি মজার। যে যাঁর মতো হাসেন। আর সেই হাসির নামও দেন। যেমন অন্যের দিকে আঙুল তুলে ঝগড়াটে হাসি। নাকি সুরে ভূত পেত্নি হাসি। দাঁত টিপে শাঁখচুন্নির হাসি। জিভ বের করে সিংহ হাসি। গরমের সময় লস্যি হাসি। সব শেষে জোরে হাততালি দিয়ে শেষ হয়। প্রশিক্ষক দেবাশিস বলেন, ‘‘আমাদের হাতের তালুতে সমস্ত অঙ্গের স্নায়ু থাকে। জোরে হাততালি দিলে স্নায়ুগুলো সতেজ থাকে। লাফিং থেরাপির মাধ্যমে ফুসফুস, হৃদযন্ত্র-সহ সমস্ত অঙ্গ ভাল থাকে। শরীরে যে কোনও রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।’’

হাসির খেলা সত্যিই কি কাজের? কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালের হার্ট সার্জেন আমানুল হক বলেন, ‘‘মানসিক চাপ হার্টের অসুখে পক্ষে ক্ষতিকর। এতে পরোক্ষ ভাবে হার্টের উপর চাপ পড়ে। সকালে হাঁটা খুবই প্রয়োজন। তার সঙ্গে হাসির মাধ্যমে মানসিক চাপ কমাতে পারলে হার্ট ভাল থাকে। রক্তচাপ ঠিক থাকে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘প্রিভেনশন ইস বেটার দ্যান কিওর। লাফিং ক্লাবে গিয়ে মন ভাল থাকলে হার্টও ভাল থাকবে।’’

লাফিং ক্লাবের এক সদস্য বলেন, ‘‘সংসারে ছোট বড় অশান্তি লেগেই থাকে। রক্তচাপ এবং সুগারের কারণে আমার জন্য অনেক টাকা খরচ হত। বাড়িতে ঝগড়া অশান্তি লেগেই থাকত। আমি মানসিক চাপে থাকতাম। এর পর লাফিং ক্লাবে যোগ দিই। এখন আমি অনেক ভাল আছি। শরীরে জড়তা নেই। আগের থেকে অনেক বেশি কাজ করতে পারি।’’ লাফিং ক্লাবে এসে মনের খুশির হাওয়া ক্যানসার, হার্টের অসুখ, কিডনির সমস্যায় ভোগা মহিলাদের। শহরের কর্নেলগোলার বাসিন্দা সুষমা রায়ের ১২ বছর আগে ক্যানসার ধরা পড়ে। মুম্বইয়ে চিকিৎসা করান। এখন লাফিং ক্লাবে নিয়মিত আসেন। সুষমাদেবী বলেন, ‘‘এখন মুম্বাইয়ে চেক আপে গেলে চিকিৎসকেরা অবাক হয়ে যান। আমি কী ভাবে এত সুস্থ আছি জানতে চান।’’

মেদিনীপুর শহরের কোতবাজারের বাসিন্দা মুক্তা পালের ছেলে কিডনির অসুখে ভুগছিলেন। ৬০ বছর বয়সে নিজের একটি কিডনি ছেলেকে দেন মুক্তাদেবী। অস্ত্রোপচারের পর থেকে গত পাঁচ বছর লাফিং ক্লাবে নিয়মিত যান। তিনি বললেন, ‘‘আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি। এখানে এলে খুব ভাল লাগে। হাসি ঠাট্টায় শরীরের সঙ্গে মানসিক শান্তি মেলে।’’ ৭৯ বছরের কোতবাজারের নমিতা দে-র একবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। তিনি এই বয়সেও প্রতিদিন সকালে লাফিং ক্লাবে আসেন। চেয়ারে বসে হাসেন। ভীমচকের বাসিন্দা অমিয় নন্দী পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামের ঘোলা পুকুরিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। নন্দীগ্রামের গন্ডগোলের সময় মানসিক চাপে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। স্নায়ুর সমস্যায় হাত পা কাঁপত। কয়েক বছর আগে অবসর নিয়েছেন। লাফিং ক্লাবের অনুশীলন করে এখন তিনি ভাল আছেন। বয়স্কদের জন্য এখন লাফিং ক্লাস শুরু হওয়ার আগে প্রাণায়াম করানো হচ্ছে। কানন কুণ্ডু জানালেন, লাফিং ক্লাবকে ঘিরে একটি বড় পরিবার গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন মনীষীদের জন্মদিন ও মৃত্যুদিন পালন করা হয়। চাঁদা তুলে দিঘা, পুরী, তারকেশ্বর, মায়াপুর বেড়াতে যাই। কেউ অসুস্থ হলে পাশে থাকেন।

জেলা শহরে কয়েকটি লাফিং ক্লাব তৈরি হলেও সদস্যের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। প্রশিক্ষক দেবাশিস বলেন, ‘‘কাজের চাপে মানুষ শরীরচর্চার সময় পাচ্ছেন না। তাই লাফিং ক্লাবগুলোতে নতুন সদস্যের সংখ্যা কমছে।’’ অরবিন্দনগরে এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে লাফিং ক্লাব শুরু হয়েছিল। সদস্য কম থাকায় সেটি বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

হাসি অনেক রকমের হয়। কিন্তু প্রাণখোলা হাসি সবার সেরা। মে মাসের প্রথম রবিবার বিশ্ব লাফিং দিবস। হা হা হাসির হট্টমেলা বসবে সেদিন। প্রাণ ভাল রাখতে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন