সম্পাদক সমীপেষু

জহর সরকার (‘মহামারী অতীত, মা শীতলা কালজয়ী’, ২৩-৩) শীতলার জন্ম প্রসঙ্গে দুটি কাহিনির উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া আরও একটি কাহিনি হল রাজা পুষ্পদন্তের পালিতা কন্যা হিসাবে শীতলার জন্মকথা। এই শীতলা শ্যামবর্ণ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০৩
Share:

শীতলা নিয়ে বাঙালিও কাজ করেছে

Advertisement

জহর সরকার (‘মহামারী অতীত, মা শীতলা কালজয়ী’, ২৩-৩) শীতলার জন্ম প্রসঙ্গে দুটি কাহিনির উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া আরও একটি কাহিনি হল রাজা পুষ্পদন্তের পালিতা কন্যা হিসাবে শীতলার জন্মকথা। এই শীতলা শ্যামবর্ণ। নহুষ রাজার পুত্রেষ্টি যজ্ঞ থেকে জাত শীতলা কৃষ্ণবর্ণ এবং ভগবতী অংশে যে শীতলা তা রক্তবর্ণ। মধ্যযুগের শীতলামঙ্গলের সব থেকে জনপ্রিয় কবি নিত্যানন্দ চক্রবর্তী কৃষ্ণবর্ণ ও শ্যামবর্ণ শীতলা নিয়ে কাব্য প্রণয়ন করেছেন।

দুই, শীতলামঙ্গলের কবিদের মধ্যে মাণিকরাম গাঙ্গুলি, দ্বিজ হরিদেব, কবি জগন্নাথ, কবি বল্লভ, কৃষ্ণরাম দাস ছাড়া রয়েছেন নিত্যানন্দ চক্রবর্তী, পরীক্ষিৎ, নন্দরাম দাস, মুকুন্দ, কৃষ্ণকিঙ্কর, শঙ্কর, দ্বিজ দয়াল, দ্বিজ রঘুনাথ, দ্বিজ গোপাল প্রমুখ।

Advertisement

তিন, আয়ুর্বেদে বসন্ত ব্যাধির নাম মসূরিকা। বঙ্গদেশে এই ব্যাধি শীতলা নামেও পরিচিত। দেবী শীতলার দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মসূরিকা রোগ হয় বলে এই রোগকে শীতলা রোগ বলে। আয়ুর্বেদে শীতলাদেবীর কথা রয়েছে।

চার, শীতলাদেবীর বাহন গাধা নির্বাচনের একটি বৈজ্ঞানিক কারণ আছে বলে মনে করি। ডা. খগেন্দ্রনাথ বসু জানাচ্ছেন, ‘বসন্ত রোগে গর্দ্দভী-দুগ্ধ বিশেষ হিতকরী এবং প্রতিষেধক।... সমস্ত জন্তুর বসন্ত রোগ হইতে পারে, কিন্তু গর্দ্দভের কখনও হইতে শুনা যায় না।’ (বসন্ত ও হাম চিকিৎসা, চতুর্থ সং, ১৩৬৫ বঙ্গাব্দ)।

পাঁচ, শীতলা ও শীতলামঙ্গল নিয়ে বাংলায়ও কিছু গবেষণা হয়েছে। তারাশিস মুখোপাধ্যায়, পুষ্প অধিকারী, পঞ্চানন মণ্ডল, ত্রিপুরা বসু, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, অমলেন্দু ভট্টাচার্য উল্লেখ্য।

ছয়, শীতলা-কাল্টকে কেন্দ্র করে বিগত কয়েক শতক জুড়ে যে ভক্তি সাহিত্য লেখা হয়েছে, তাকে কেন্দ্র করে গ্রাম বাংলার বিনোদন সংস্কৃতিও একটা রূপ পেয়েছে। জন্ম নিয়েছে পালাগানের এক ভিন্ন ধারা। বিশেষ করে, দক্ষিণবঙ্গের অধিকাংশ গ্রাম মুখরিত হয় এই শীতলা সংস্কৃতিতে।

সাত, পরিতাপের বিষয়, এই সব গানের রচয়িতাদের স্বীকৃতির কোনও উদ্যোগ কোথাও নেই। শীতলামঙ্গলের বিভিন্ন কবির প্রাপ্ত পুথি সংগ্রহ-সংরক্ষণ বা প্রকাশেরও উদ্যোগ নেই।

শ্যামল বেরা। আন্দুল, হাওড়া

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, দীনেশচন্দ্র সেন, ব্যোমকেশ মুস্তাফি প্রভৃতি পণ্ডিত বৌদ্ধদেবী হারীতীর সঙ্গে শীতলার কল্পনা করেছেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী অনুমান করেছেন, বৌদ্ধদেবী হারীতীই পরবর্তী কালে হিন্দুদেবী শীতলাতে রূপান্তরিত হয়েছেন।

নেপালেও বসন্ত রোগের অধিষ্ঠাত্রী দেবী রূপে বৌদ্ধদেবী হারীতীর পূজার প্রচলন আছে। যদিও বৌদ্ধতন্ত্রে হারীতী হলেন যক্ষপতি কুবেরের পত্নী। তিনি ধনদাত্রী।

হারীতী বসন্ত রোগের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেও তিনি আবার একই সঙ্গে সন্তান হরণ ও রক্ষণ উভয়েরই দেবী। কখনও তিনি সন্তান বিনষ্টকারী ভয়ংকর অপদেবতার দেবী, আবার কখনও তিনি শিশুপরিবৃতা প্রসন্নবদনা, সন্তানকে স্তনদানরতা মাতৃদেবীর প্রতিমূর্তি রূপে ভাস্কর্যে আবির্ভূতা। হারীতীর মূর্তি কেবল ভারতের বিভিন্ন জাদুঘরে নয়, বাংলাদেশে ঢাকার সংগ্রহশালায় একটি এবং রাজশাহির সংগ্রহশালায় প্রস্তর ও ধাতু নির্মিত হারীতীর চারটি মূর্তি সংরক্ষিত আছে।

বাংলার শীতলামঙ্গল কাব্যেও শীতলাদেবীকে কখনও কখনও ক্রোধান্বিত রূপে দেখা যায়। তিনি অলৌকিক শক্তি প্রদর্শন করেছেন শিশু বিনষ্টির মধ্য দিয়ে। শীতলার আদেশে পুত্রদের মঙ্গল কামনা করে তাঁর (শীতলার) পূজায় অনিচ্ছুক রাজার ১০০টি পুত্রের মধ্যে ৬৯টি পুত্রকে বসন্ত রোগে প্রাণত্যাগ করতে হয়েছিল। হারীতী এবং শীতলা, উভয়েই বসন্ত রোগের অধিষ্ঠাত্রী দেবী এবং উভয়ই পূজিত হতেন ডোম পুরোহিতের দ্বারা।

মঙ্গলকাব্য বিষয়ক পণ্ডিত আশুতোষ ভট্টাচার্য শীতলার সঙ্গে দাক্ষিণাত্যের লৌকিক দেবী শীতলম্মার ঘনিষ্ঠতাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বরং তিনি বৌদ্ধদেবী হারীতীর সঙ্গে শীতলার সম্পর্ককে অস্বীকার করেছেন। নলিনীনাথ দাশগুপ্তেরও অনুরূপ অভিমত।

রাহুল বড়ুয়া। কলকাতা-৭৪

ফাল্গুনেই শীতলা পূজা হয়, তা কিন্তু নয়। সারা চৈত্র মাস মঙ্গল ও শনিবার ওই পূজা হয়। উত্তরবঙ্গের কথা জানি না। হাওড়া-সহ দক্ষিণবঙ্গের অনেক জেলায় চৈত্র মাসে পূজা সুপ্রচলিত। শহরে বা গ্রামে গঞ্জে। শিবগঞ্জ গ্রামের কিছু দূরে শ্যামপুর (হাওড়া) একমাস কাল পূজা হয় খুব ধুমধাম করে। কলকাতার বেলগাছিয়ায় শ্রীশীতলা মন্দিরের পূজা হয় সারা চৈত্র মাস। পূজার বিবরণ বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকায় আছে।

কলেরার জন্য ‘ওলাদেবী’ পূজা পান শীতলার সঙ্গে। সঠিক নাম কিন্তু ওলাবিবি। বিভিন্ন স্থানে গ্রাম সংলগ্ন ধানজমির উঁচু পতিত জমিতে ওলাবিবির থান। হিন্দু মুসলমান সবাই কলেরা রোগ নিরাময়ের জন্য মিষ্টি ও ফল দিয়ে মানত করেন।

বর্তমানে প্রতিমা পূজাই প্রচলিত শীতলা মন্দিরে। বাঘা যতীন এলাকায় পাটুলি পর্যন্ত বহু শীতলা মন্দির আছে। প্রতিমার বর্ণনায় দেখি, শ্বেতাঙ্গী বা শ্যামাঙ্গী দ্বিভুজা, সুলোচনা সালঙ্কারা রাসভ (গাধা) পৃষ্ঠে উপবিষ্টা। রক্তবস্ত্র। ডান হাতে ঝাঁটা বাম হাতে জলভরা কলসি।

উল্লেখ করা হয়েছে অন্য দেবদেবী ভাল ভাল বাহন দখল করার ফলে শীতলার গাধা ছাড়া কোনও বাহন জোটেনি। এমনটা ভাবার কোনও সঙ্গত কারণ নেই। কারণ, আয়ুর্বেদ শাস্ত্র মতে, গাধার দুধ বসন্ত রোগ প্রতিরোধ করে বলেই ওই বাহন নির্দিষ্ট হয়েছে। বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকায় এর সমর্থন রয়েছে। মাঘ মাসের দ্বিতীয় পক্ষে শীতলা ষষ্ঠী পালিত হয়। কিন্তু ওই নামে কোনও ব্রত বা পূজার উল্লেখ নেই কোনও পঞ্জিকা বা স্বীকৃত কোনও পূজা ব্রত-বইতে। বরং শ্রীপঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজার পর দিন ষষ্ঠী তিথিতে যে ব্রত পালিত হয় তার নাম শীতল ষষ্ঠী। ওই ব্রত স্বামী পুত্রের মঙ্গলের জন্য মেয়েরা পালন করে। সঙ্গে মঙ্গলসূত্র (সাদা) বেঁধে দেয় হাতে। পঞ্জিকায় এই ব্রতেরই নামোল্লেখ আছে শীতল ষষ্ঠী নামে।

সরকারি চাকুরিরত অবস্থায় কাটোয়া বর্ধমান জেলা শহর খড়্গপুর মেদিনীপুর (অবিভক্ত) তমলুক কাঁথি হলদিয়া ঘাটাল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা হাওড়া প্রভৃতি স্থানে অতি প্রসিদ্ধ প্রাচীন শীতলা মন্দির দেখার সুযোগ হয়েছে এবং সবই প্রতিমা। কোথাও কোথাও শীতলা মনসা গঙ্গা মূর্তি একত্র রয়েছে।

সুনীতি গুড়িয়া। কলকাতা-৮৬

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন