সম্পাদক সমীপেষু

অষ্টাদশ শতকে অবিভক্ত বাংলায় মল্লরাজ পৃষ্ঠপোষকতায় বিষ্ণুপুরে সংগীত ঘরানার সূত্রপাত। এই নিয়েই পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতিকেন্দ্র প্রযোজিত ‘দ্য বিষ্ণুপুর ঘরানা’ শীর্ষক একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেছেন অশোক বিশ্বনাথন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ মে ২০১৬ ০০:৫৫
Share:

গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়

বিষ্ণুপুর ঘরানা ও তানসেন

Advertisement

অষ্টাদশ শতকে অবিভক্ত বাংলায় মল্লরাজ পৃষ্ঠপোষকতায় বিষ্ণুপুরে সংগীত ঘরানার সূত্রপাত। এই নিয়েই পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতিকেন্দ্র প্রযোজিত ‘দ্য বিষ্ণুপুর ঘরানা’ শীর্ষক একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেছেন অশোক বিশ্বনাথন। তবে বিষ্ণুপুর ঘরানা তৈরির মূলে তানসেন বংশীয় এক গুণীর (‘বিষ্ণুপুর ঘরানা’, কলকাতার কড়চা, ২৫-৪) অবদানের কথা প্রচারিত হলেও এর কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। শুধুমাত্র ঘরানাতে কৌলীন্যের কথা প্রচারের জন্যই উক্ত গুণীর আগমনের কথা চাউর করা হয়। সত্যি কথা বলতে, বিষ্ণুপুর ঘরানার গায়কী বা ঢং নিয়ে রসিকমহলে এক উন্নাসিকতা প্রকাশ পেয়েছিল। বিষ্ণুপুরী গায়কীর পক্ষ অবলম্বন করে রবীন্দ্রনাথকে লিখতে হয়, ‘আর একটি বিষয় নিয়ে তর্ক হচ্ছে— গোপেশ্বরবাবুর গানের স্টাইলটা বিষ্ণুপুরী বলে কেউ কেউ তাঁর ওস্তাদিতে কলঙ্ক আরোপ করে থাকেন। সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্রে দেখা যায় যে, প্রদেশ ভেদে সাহিত্যের স্বাভাবিক রীতিভেদ স্বীকার করা হয়েছে। তেমনই হিন্দুস্থানী গান বাংলাদেশে যদি কোনও বিশেষ রীতি অবলম্বন করে থাকে, তবে তার স্বাতন্ত্র্য মেনে নিতে হবে। সেই রীতির মধ্যেও যে উৎকর্ষের স্থান নেই, তা বলা চলে না। যদুভট্টের প্রতিভার প্রথম ভূমিকা এই বিষ্ণুপুরী রীতিতেই; রাধিকা গোস্বামী সম্বন্ধেও সেই কথা বলা চলে। পশ্চিমদেশী শ্রোতারা যদি এই রীতির গান পছন্দ নাও ক’রে, তবে সেটাকেই চরম বিচার বলে মেনে নেওয়া চলে না। রসবোধ সম্বন্ধে মতভেদ অভ্যাসের পার্থক্যের উপর কম নির্ভর করে না। এমনও যদি ঘটে যে, কোনও বিশেষ গায়কের মুখে বিষ্ণুপুরী রীতির গান সত্যিই প্রশংসাযোগ্য না হয়ে থাকে, তাতে সাধারণ ভাবে বিষ্ণুপুরী রীতিকে নিন্দা করা উচিত হয় না।’ ১৩৩৫ বঙ্গাব্দে বিষ্ণুপুর ঘরানার গায়কী নিয়ে রবীন্দ্রনাথের উক্ত সওয়াল। আবার, নিন্দার হাত থেকে বাঁচানোর তাগিদ থেকে বিষ্ণুপুরে তানসেনের এক বংশধরের আগমন ও শিক্ষাদানের গল্পের প্রচার।

তবে বিষ্ণুপুর ঘরানার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গুণী সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বিষ্ণুপুরে তানসেনের বংশধরের আগমন তত্ত্বটি খারিজ করেছেন। তিনি তাঁর ‘বিষ্ণুপুর ঘরাণার প্রকৃত ইতিহাস ও রাগরূপের সঠিক পরিচয়’ বইয়ে (১৩৮৪) জানাচ্ছেন, ‘এখানের ঘরাণার ইতিহাস যে এক জন বিখ্যাত সংগীতগুণীর দ্বারা লিখিত হয়ে প্রচারিত হয়েছে, তাকেই প্রায় সকলে সঠিক মনে করে গ্রহণ করে নিয়েছিল। এমনকী, পরবর্তী কোন কোন লেখক বিষ্ণুপুর ঘরাণার পরিচয় রাখতে গিয়ে তাঁর দেওয়া ইতিহাসকেই উদ্ধৃত করেছেন। ... ইতিহাস লেখক অভ্রান্ত, এই বিশ্বাস রেখে, প্রকৃত তথ্য অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না। যাই হোক, কিন্তু ঘরাণা সৃষ্টিতত্ত্বের তাঁর দেয় পরিচয়টি বাস্তবভিত্তিক যে নয়, কল্পনাপ্রসূত, সে খবর আমাদের বংশের দু’চার জন ছাড়া আর কেউই জানেন না।’

Advertisement

রচনার পরবর্তী অংশে সংগীতাচার্য সত্যকিঙ্কর খোলাখুলিই লিখেছেন যে, ঘরানা সৃষ্টিতত্ত্বের কল্পনাপ্রসূত ইতিহাসের রচনাকার ছিলেন তাঁর মেজকাকা তথা সংগীতগুরু আচার্য গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। সত্যকিঙ্কর লিখেছেন, ‘‘তিনি আমাকে এক দিন বলেছিলেন, আমাদের ঘরাণা পরিচয় না থাকার জন্য মর্য্যাদা ক্ষুণ্ণ হচ্ছিল, অনেকেই উন্নাসিকতা দেখিয়ে বলতেন, বিষ্ণুপুর ঘরাণার কোন কৌলীন্য মর্য্যাদা নেই, তাই আমি তানসেন বংশধর বলে পরিচয় দিয়ে বাহাদুর সেন নাম সৃষ্টি করে মল্লমহারাজ দ্বিতীয় রঘুনাথ দ্বারা উক্ত গায়ককে আনিয়ে বিষ্ণুপুর ঘরাণার সৃষ্টি পরিচয় স্থাপিত করি। তার পর থেকেই এই ঘরাণার প্রতি বেশ শ্রদ্ধা এসেছে।’ আমি এই কথা শুনে খুব হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, যে দেশে গদাধর, রামশঙ্কর, যদুভট্ট, নিতাই নাজির, বৃন্দাবন নাজির এবং আমাদের বংশের পূর্বতন ব্যক্তিদের মত বিখ্যাত গায়ক গুণী সৃষ্টি হয়েছে, সেই পরিচয়ই কি সব চেয়ে বড় পরিচয় নয়?’’

দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়ও তাঁর গবেষণাধর্মী ‘বিষ্ণুপুরে ধ্রুপদসঙ্গীতের ধারা ও রামশঙ্কর ভট্টাচার্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে বাহাদুর খাঁ বা বাহাদুর সেনের বিষ্ণুপুরে আগমন ও শিক্ষাদান তত্ত্বটি ইতিহাস ও যুক্তির নিরিখে নস্যাৎ করেছেন। প্রবন্ধটিতে শ্রীমুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘‘উক্ত ধারণার ঐতিহাসিকতার অসম্ভবতা ও ভ্রম প্রদর্শন করে এবং বিষ্ণুপুরে ধ্রুপদ সঙ্গীতচর্চার প্রথম যুগ থেকে পরিচয় দিয়ে একটি পুস্তক, বর্তমান লেখকের ‘বিষ্ণুপুর ঘরানা’ ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে। বিষ্ণুপুর ঘরানার দু’জন শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি তখনও বিদ্যমান ছিলেন— গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ও রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তাঁরা কিংবা অপর কেউ শেষোক্ত পুস্তকের বিষয়বস্তু ও মতামতের বিপক্ষে কোনো প্রকার সমালোচনা কিংবা প্রতিবাদ করেননি।’’

মল্লরাজ দ্বিতীয় রঘুনাথের রাজত্বকাল ১৭০২-১৭১২ খ্রিস্টাব্দ। অন্য দিকে, তানসেন বংশীয় বাহাদুর খাঁর পিতামহ ভারতবিখ্যাত খেয়ালিয়া সদারঙ্গ দিল্লির বাদশা মহম্মদ শাহের দরবারে ছিলেন ১৭১৯-১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। সেই কথা বিচার করে দিলীপকুমার জানাচ্ছেন, ‘অর্থাৎ রাজা রঘুনাথ সিংহ ও বাহাদুর খাঁর মধ্যে দুই বা তিন পুরুষের ব্যবধান’। তাঁর বিচারে, ‘যদি তর্কের হিসেবে ধরা হয় যে, বাহাদুর খাঁ নামক কোন ধ্রুপদী রঘুনাথের দরবারে ১৭১২ খৃস্টাব্দের পূর্বে নিযুক্ত ছিলেন তা হলে তাঁর পক্ষে গদাধর চক্রবর্তী বা রামশঙ্কর ভট্টাচার্যকে সংগীত শিক্ষা দেওয়া অসম্ভব। কারণ, শেষোক্ত দু’জনেরই জন্ম অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে।’

বিষ্ণুপুরে বাহাদুর খানের আগমন তত্ত্বটির প্রহেলিকা নিরসনে দিলীপকুমারের বক্তব্য, ‘বহুদিন যাবৎ সর্ববাদীসম্মত ভাবে এই মতের প্রচলনের বৃত্তান্ত অনুসরণ করে দেখা গেছে যে, বিষ্ণুপুর নিবাসী গায়ক ও রামশঙ্করের শেষ জীবনের এক শিষ্য অনন্তলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র রামপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম উক্ত মর্মে অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। রামপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বরলিপি সমন্বিত সংগীত সংকলন গ্রন্থ ‘সঙ্গীত মঞ্জরী’তেই প্রথম লিখিত হয়, রাজা দ্বিতীয় রঘুনাথের রাজসভায় ওস্তাদ বাহাদুর খাঁর আগমন ও অবস্থানের কথা। সন ১৩০০ সালে বা ১৮৯৩-৯৪ খৃঃ পুস্তকটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।’ দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়ের উক্ত বক্তব্যেও ভ্রান্তি আছে। সবিনয়ে জানাই, রামপ্রসন্ন সম্পাদিত ‘সঙ্গীত মঞ্জরী’র প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৩১৪ বঙ্গাব্দের বৈশাখে। বাহাদুর খাঁর আগমন তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য যে বইটিকে ভিত্তি করে গবেষক দিলীপকুমার কালীভক্ত ‘প্রসন্ন ওস্তাদ’কে কাঠগড়ায় তুলেছেন, সেই বইটির প্রথম সংস্করণ দিলীপকুমার নিজেই দেখেননি। ‘সঙ্গীত মঞ্জরী’র প্রথম সংস্করণে বাহাদুর খাঁর নামগন্ধ পর্যন্ত নেই। আচার্য রামপ্রসন্ন গত হওয়ার পাঁচ বছর পর তাঁর অনুজ আচার্য গোপেশ্বর কর্তৃক সম্পাদিত ‘সঙ্গীত মঞ্জরী’র দ্বিতীয় সংস্করণে সাহানা-চৌতালে নিবদ্ধ বাহাদুর খাঁ বা বাহাদুর সেন রচিত রঘুনাথ স্তুতি সূচক একটি ধ্রুপদ ও সঙ্গে পাদটীকা ছাপা হয়। এ হেন একটি ঐতিহাসিক বিশেষত্বপূর্ণ ধ্রুপদ রামপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অতি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত ভাবে প্রথম সংস্করণে তাঁর সম্পাদনা কালে বাদ দিয়েছেন— এ হতে পারে না। কেননা, তর্কের খাতিরে বলতেই হয় এই ধ্রপদটি নিয়েই তো বিষ্ণুপুরে বাহাদুর খাঁ তত্ত্বের প্রতিষ্ঠার সূচনা। অতএব, বিষ্ণুপুর ঘরানায় তানসেনবংশীয় তত্ত্ব বা প্রহেলিকা নিরসনে ‘সঙ্গীত মঞ্জরী’র প্রথম সংস্করণটির গুরুত্ব প্রশ্নাতীত ও অপরিহার্য।

আসলে, বিষ্ণুপুরে অনাড়ম্বর চালের ধ্রুপদ চর্চার আদি উৎস হল মথুরা-বৃন্দাবন অঞ্চলে প্রচলিত হাবেলি সংগীত, যা ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে ওই অঞ্চলে বিষ্ণুপদ নামেও খ্যাত ছিল। এই বিষ্ণুস্তুতিমূলক গায়কী বৃন্দাবন থেকে আগত বৈষ্ণব সাধক সংগীতজ্ঞদের দ্বারা বিষ্ণুপুরে প্রচারিত হয়। রাঢ় গবেষক মানিকলাল সিংহ জানাচ্ছেন, ‘এই গানগুলি ষট্ গোস্বামীর আমলে বা তাহারই সামান্য পরবর্তী সময়ে লিখিত ভারতের বিভিন্ন সাধকভক্ত ও সুগায়কদের দ্বারা রচিত। তুলসীদাস, ব্রহ্মদাস, জানকীদাস, পরমানন্দ, পরমেশ্বর, হরিদাস, শূরদাস ইহাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। কতকগুলি গান মোঘল সম্রাট আকবর, জাঁহাঙ্গীরের প্রসস্তি বিষয়ক।’ এই চর্চার সূত্র ধরেই বিষ্ণুপুরের হাওয়া সংগীতমুখী হয়। অষ্টাদশ শতকে শ্রীক্ষেত্রগামী ব্রজমণ্ডল নিবাসী জনৈক সংগীতজ্ঞ ‘পণ্ডিতজি’ গুরুর কাছে রামশঙ্কর সেই প্রার্থনাধর্মী অলঙ্কার বর্জিত ধ্রুপদ গায়কী আয়ত্ত করেন। অনাড়ম্বরতা ছিল সেই গায়কীর মূল সূত্র। এখানেই পশ্চিমা গায়কীর সঙ্গে বিষ্ণুপুরী ধ্রুপদের পার্থক্য। যা পশ্চিমা গায়কীতে শিক্ষিত কাশীর বিখ্যাত ধ্রুপদীয়া হরিনারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের ভাষায়, ‘বিষ্ণুপুরী ঢং’।

জয়দীপ মুখোপাধ্যায়। অরবিন্দনগর, বাঁকুড়া

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন