গণতন্ত্রকে শেষ করে দেওয়ার ‘যুক্তি’
গণতন্ত্রকে শেষ করে দেওয়ার ‘যুক্তি’সম্পাদকীয় ‘রাজধর্ম’, সুগত মারজিতের ‘সমালোচনা জরুরি, ভারসাম্যও’ এবং অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভোট কী পারে, কী পারে না’ —পাশাপাশি তিনটি লেখা (২৫-৫) পড়ে আমি তাড়িত নয়, নাড়িত। তাই কিছু কথা।
সম্পাদকীয়তে আপনি বলেছেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী কঠোর ভাবে প্রশাসনকে বলুন, দলীয় রং বিচারের প্রয়োজন নেই।... নিরপেক্ষ প্রশাসন রাজধর্মের প্রথম শর্ত।’ এ কথার প্রশংসা করা মানুষের স্বভাবধর্ম হওয়া উচিত। কিন্তু নির্বাচনের আগে ও পরে কথায় ও কাজে মুখ্যমন্ত্রী ভারতের নির্বাচন কমিশনের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যা বলেছেন বা করেছেন, তা কতখানি ভারসাম্যহীন, সেটা সুগত মারজিৎ মশাইকে ভাবতে অনুরোধ করব। নির্বাচনী স্বার্থ রক্ষার কাজে কার্যত তত্ত্বাবধায়ক মুখ্যমন্ত্রী যে ভাষায় যে ভাবে হুঁশিয়ারি দিয়ে ও আমলাদের বদলি করে প্রশাসনিক নিরপেক্ষতাকে আঘাত করার উদাহরণ সৃষ্টি করলেন, তা কোনও রাজ্যের রাজনৈতিক ইতিহাসে আছে কি? বিপুল জনসমর্থনের পরেও এমনতর আচরণের প্রয়োজন হচ্ছে কেন?
সুগত মারজিৎ বলেছেন, ‘সাম্প্রতিক কালে সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে নেত্রীর প্রতি মানুষের অগাধ প্রত্যয়।’ কথাটি ভুল নয়। কিন্তু পরিচ্ছন্ন নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন অনেক সদিচ্ছা ও প্রচেষ্টায় যে ঐতিহাসিক উদাহরণ সৃষ্টি করেছে আমলাদের সাহায্যে, তার প্রশংসা নেই তাঁর লেখায়। ভারসাম্য থাকল কি? তিনি বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এত সক্রিয় মিডিয়া কোনও দিন দেখেনি। বলেছেন, মিডিয়ার দিক থেকে দোষ খোঁজার প্রবণতা বেশি চোখে পড়েছে, এটা মিডিয়ার পক্ষে হিতকর নয়। বলেছেন, আত্মসমীক্ষণের প্রয়োজন। তা অবশ্যই, যদি সত্যের অপলাপ ঘটে। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে সত্যের অপলাপের উদাহরণ কি কম? ধারাবাহিক কৃষক ও চা শ্রমিকের আত্মহত্যা, দুর্নীতি, ধর্ষণ, ছাত্র যুবাদের বিশৃঙ্খলা ও অনাচার, অন্য দলের অফিস ভাঙা ও আগুন লাগানো, নিরীহ মানুষকে মারধর— প্রায়শ সব কিছুকে অস্বীকার করা হয়েছে বা হচ্ছে। অস্বীকার করা হয়েছে দলে রাজনৈতিক ভাবেও। তা হলে কারা করছে অপরাধ? ভূতে? সরকারকেই তো সেই ভূত তাড়াতে হবে। এই কথাটা না বললে আলোচনায় ভারসাম্য কোথায়?
অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছেন তাঁর লেখায়: এক দিকে, স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মহল থেকে প্রচার করা হচ্ছে অন্য কিছু রাজ্যের মতো এই রাজ্যেও রাজনীতিকদের দুর্নীতি নিয়ে মানুষ মাথা ঘামান না, এ বারের ভোটের ফল তার প্রমাণ; অন্য দিকে, সারদা, নারদা ও স্টিং ভিডিয়োর সাক্ষ্যের কথা বললে শাসক দলের নেতারা বলেছেন ১৯ মে-র খবরে উত্তর পেয়ে যাবেন। অর্থাৎ ভোটে জয়ী হলেই প্রমাণিত হবে যে, অভিযুক্তরা সবাই নির্দোষ। ভোটের ফল প্রকাশের পরে মুখ্যমন্ত্রীও বলে দিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতি নেই।
রাজনীতিতে একটা ‘যুক্তি’র জন্ম দেওয়া হয়েছে অনেক দিন ধরে। ভোটে জয়ী জনপ্রতিনিধিরা অনেকে বলে আসছেন, যা করেছি, বেশ করেছি। আমি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। অর্থাৎ কিছু ভোট বেশি পেলেই পাঁচ বছরের জন্য তাঁর বা তাঁদের সাতখুন মাফ। দেশে যা কিছু আইন আছে, তাদের সবার ওপরে ওই জনপ্রতিনিধিদের অবস্থান। এই সব অপরূপ যুক্তির তেজস্ক্রিয়তায় তো গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটবে।
শেক্সপিয়র রোমান মব-এর চরিত্র এঁকে রেখে গেছেন। অস্বীকার করার উপায় নেই, এই ‘মব’ সব দেশে সব কালে ছিল, আছে, হয়তো থাকবে। তাদের ভোটে জেতা বা হারার ঘটনাও ঘটতে থাকবে। ক্ষমতাপিয়াসী রাজনীতি তাতে লজ্জা পাবে কি পাবে না, তা নির্ভর করবে জাতীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর। পৃথিবীতে কয়েকটি সংস্থা কিছু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রায়শ বিচার করে দুর্নীতির মাপকাঠিতে কোন দেশের অবস্থান কোথায়। আমরা দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তাতে ভারতের স্থান সবার পিছে না হলেও খুবই নীচে। কিন্তু তাতে দেশের ক্ষমতাসীন ও দুর্নীতিগ্রস্ত ঐশ্বর্যবানদের কী যায় আসে!
নীলকণ্ঠ ঘোষাল। কলকাতা-৬৩
(অ)রাজনীতি
সাম্য কার্ফার রিপোর্টে জানলাম, কালিন্দী ব্রাত্যজন আয়োজিত পঞ্চম আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসবে অংশগ্রহণকারী মিশরের নাট্যকর্মীরা নাটক বাছাই বা নাটক লেখার ক্ষেত্রেও রাজনীতিকে এড়িয়ে চলতে চান (‘মিশর মানেই নৈরাজ্য নয়...’, ৪-৬)। রাজনীতি এড়িয়ে চলাও কিন্তু এক ধরনের রাজনীতি। তথাকথিত অরাজনৈতিক নাটক বা চলচ্চিত্রেও রাজনীতি থাকে। ‘পদাতিক’ রাজনৈতিক, ‘বাবা তারকনাথ’ও। শুধু প্রথমটিতে আছে দিন বদলের প্রত্যয় আর দ্বিতীয়টি মানুষকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন করে এক পূতিগন্ধময় সমাজ তৈরিতে ইন্ধন জোগায়।
শেক্সপিয়র থেকে রবীন্দ্রনাথ, চেকভ থেকে ব্রেখট— কারওর নাটকই কি রাজনীতি বর্জিত? রক্তকরবী কি আধ্যাত্মিকতার সহজপাঠ? ম্যাকবেথের চেয়ে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বেটার প্লে হতে পারে না, বলেছিলেন উৎপল দত্ত। ব্রাত্য বসুর রুদ্ধসংগীত কি রাজনাতির ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলে?
নাট্যকর্মীরা যা বলে গেলেন, সেটাই যদি মিশরে নাট্য আন্দোলনের ট্রেন্ড হয় তা হলে বলতেই হয়, তার ভবিষ্যৎ খুব ভাল নয়। সমাজের প্রতি শিল্পীর দায়িত্ব বিস্মৃত হয়ে সামাজিক বা রাজনৈতিক সংগ্রামে না জড়িয়ে মহৎ সৃষ্টি সম্ভব নয়।
শিবাজী ভাদুড়ী। সাঁত্রাগাছি, হাওড়া-৪
হঠকারিতা!
সংযুক্তা বসুর নেওয়া ‘পরাণওয়ালা’ (পত্রিকা, ২৮-৫) সাক্ষাৎকারে প্রবীণ অভিনেতা পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন: পুরস্কার না-নেওয়ার মধ্যে একটা হঠকারিতা থাকে।
পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের বহু ঘটনা থেকে তিনটি দৃষ্টান্ত স্মরণ করছি। ১৯১৯-এ জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংসতার প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথের নাইট উপাধি ত্যাগ, ১৯৫৯-এ শিশিরকুমার ভাদুড়ীর পদ্মভূষণ গ্রহণে অস্বীকৃতি এবং ১৯৬৪-তে জাঁ পল সার্ত্রের নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান।
এ সব প্রতিবাদের তাৎপর্য আমরা নাই বুঝতে পারি, কিন্তু এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যানগুলিকে হঠকারী বলব কি?
নির্মল সাহা। কলকাতা-২৯