সম্পাদক সমীপেষু: বাংলা কাগজের জনক

১৮১৮-২০১৭। কেবল বাংলা নয়, যে কোনও ভারতীয় ভাষাতেই সংবাদপত্র প্রকাশনার বয়স দুশোয় পড়ল এই বছরে। ১৮১৮ সালের ১৫ মে শুক্রবার বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র সাপ্তাহিক ‘বঙ্গাল গেজেটি’ প্রকাশ করেন কালনা মহকুমার পাটুলির বহরা গ্রামের বাসিন্দা গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share:

উপেক্ষিত: বহরায় গঙ্গাকিশোরের স্মৃতিস্তম্ভ। ছবি স্বপনকুমার ঠাকুর

১৮১৮-২০১৭। কেবল বাংলা নয়, যে কোনও ভারতীয় ভাষাতেই সংবাদপত্র প্রকাশনার বয়স দুশোয় পড়ল এই বছরে। ১৮১৮ সালের ১৫ মে শুক্রবার বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র সাপ্তাহিক ‘বঙ্গাল গেজেটি’ প্রকাশ করেন কালনা মহকুমার পাটুলির বহরা গ্রামের বাসিন্দা গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য। এই গ্রামেই ছিল তাঁর বাসস্থান ও ছাপাখানা।

Advertisement

কর্মজীবনের শুরুতে গঙ্গাকিশোর কাজ করতেন হুগলির শ্রীরামপুরের এক মিশনারি প্রেসে, পরে নিজেই কলকাতায় ছাপাখানার ব্যবসা শুরু করেন। কলকাতায় ছাপাখানা আসার আদিপর্বে শ্রীরামপুরের মিশনারি প্রেস থেকেই বাংলা বই ছাপা হত। গঙ্গাকিশোরের আরও এক অনন্য কীর্তি প্রথম বাংলা সচিত্র বই মুদ্রণ। ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ সচিত্র গ্রন্থ তিনি প্রথম কলকাতায় প্রকাশ করেন ১৮১৬ সালে। অবিভক্ত ভারতে প্রথম সংবাদপত্র ইংরেজি ভাষায়। ‘বেঙ্গল গেজেট’ নামক ইংরেজি সংবাদপত্রটি জেমস অগাস্টাস হিকি প্রকাশ করেন ১৭৮০ সালে। গঙ্গাকিশোর প্রকাশ করেন দেশীয় ভাষার প্রথম সংবাদপত্র ‘বঙ্গাল গেজেটি’ তার ৩৮ বছর পরে। ১৮১৮ সালেরই ২৩ মে শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন থেকে জন ক্লার্ক মার্শম্যান প্রকাশ করেন সাপ্তাহিক ‘সমাচার দর্পণ’। এই পত্রিকাটিকে আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলার প্রথম সংবাদপত্রের স্বীকৃতি দেওয়া হয়, সে সরকারি ভাবেই হোক বা ইতিহাসবিদদের দৃষ্টিকোণ থেকে। কারণ, আশ্চর্যজনক ভাবে গঙ্গাকিশোর সম্পাদিত প্রথম সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের কোনও কপি আজ অবধি পাওয়া যায়নি।

তবে কেন বর্ধমান জেলার মানুষ গঙ্গাকিশোরকেই বাংলা সংবাদপত্রের পথিকৃৎ রূপে স্বীকৃতি দেন? এর নেপথ্যে আছে বর্ধমান থেকে একদা প্রকাশিত ‘দামোদর’ পত্রিকার সম্পাদক দাশরথি তা এবং তার সহযোগী কালিপদ সিংহ-সহ স্থানীয় উদ্যোগী সংস্কৃতিপ্রিয় বেশ কয়েক জন মানুষের দীর্ঘ কয়েক বছরের নিরলস গবেষণায় গঙ্গাকিশোর ও বঙ্গাল গেজেটি সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্যের উন্মোচন, যা প্রমাণ করে মার্শম্যানের এক সপ্তাহ পূর্বেই গঙ্গাকিশোর সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। কিন্তু তিনি কলকাতা থেকে বহু দূরবর্তী প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা হওয়ার কারণেই হোক অথবা সৃষ্টিকর্তা এক জন নেটিভ বাঙালি হওয়ার কারণেই হোক, তাঁর সৃষ্টিতে সরকারি সিলমোহর লাগানো হয়নি। একটি তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরছি; গঙ্গাকিশোরের সহযোগী হরচন্দ্র রায় তৎকালীন সরকারি গেজেটে একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেন ১৮১৮ সালের ১৪ মে, ‘হরচন্দ্র রায় বেগস লিভ টু ইনফর্ম... হি হ্যাজ এস্টাবলিশড আ বেঙ্গলি প্রেস... ইনটেন্ডস টু পাবলিশ আ উইকলি বেঙ্গল গেজেটি... হরচন্দ্র রায়। ১৪৫ চোরবাগান স্ট্রিট প্রাইস রুপিজ ২ পার মান্থ (গভঃ গেজেট, ১৪ মে ১৮১৮)’। ১৮১৮ সালে ১ জুলাই হরচন্দ্র রায়ের নামে গভঃ গেজেটে আরও একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়, যা থেকে জানা যায় পত্রিকাটি চলছে। এবং জানা যায় পত্রিকাটিতে বেসামরিক নিয়োগের বিজ্ঞাপন, সরকারি বিজ্ঞপ্তি ইত্যাদি প্রকাশ করা হয়। মাসিক চাঁদা ২ টাকা।

Advertisement

যদিও দুটি বিজ্ঞাপনে গঙ্গাকিশোরের নামোল্লেখ নেই, কিন্তু যে হেতু তিনি এবং হরচন্দ্র যৌথ ভাবে ব্যবসার অংশীদার ছিলেন, সুতরাং এটি প্রমাণ করে বঙ্গাল গেজেটি-ই বাংলায় প্রথম সংবাদপত্র। বঙ্গাল গেজেটির জনক রূপে প্রথম গঙ্গাকিশোরের নাম উল্লেখ হয় ১৮২০ সালের সেপ্টেম্বরে ইংরাজি পত্রিকা ‘ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া’-তে। এবং ১৮৩১ সালের ১১ জুন সমাচার দর্পণ পত্রিকার একটি বিশেষ প্রতিবেদনে। পরবর্তী কালে ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকার সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ১৮৫২ সালে ‘সংবাদপত্রের ইতিবৃত্ত’ নামক গ্রন্থে এবং ১৮৫৫ সালে পাদরি লং ‘ডেসক্রেপটিভ ক্যাটালগ অব বেঙ্গলি ওয়ার্কাস’ গ্রন্থে স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন গঙ্গাকিশোর সম্পাদিত বঙ্গাল গেজেটি-ই বাংলা ভাষায় প্রথম সংবাদপত্র।

সে কালের সামাজিক কুসংস্কার, বিদেশি নিপীড়ন ও স্বদেশপ্রেমের বহু মূল্যবান রচনা বঙ্গাল গেজেটিতে প্রকাশিত হয়েছিল। তার উল্লেখ পরবর্তী কালে বহু গ্রন্থে আছে। যেমন ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘সাহিত্য সাধক চরিত মালা’। দাশরথি তা সম্পাদিত ‘দৈনিক দামোদর’-এর ৩১ বৈশাখ ১৩৮২ সংখ্যায় ১৮১৯ সালের ২ এপ্রিল কলকাতা কাউন্সিল অব চেম্বারের সেক্রেটারি এম এ বেলির হাতে লেখা একটি আদেশনামা ছাপা হয়েছে। এতে উল্লেখ আছে কলকাতা থেকে গঙ্গাকিশোর তার নিজ গ্রাম বহরায় ছাপাখানা তুলে নিয়ে যেতে চান। খুব সম্ভবত এই সময় হরচন্দ্র রায়ের সঙ্গে গঙ্গাকিশোরের মতভেদ হয়। যে হেতু তিনি প্রকাশক, তাই সেটিকে আলাদা ভাবে প্রকাশ করার জন্য তিনি তৎকালীন সরকারের অনুমতির আবেদন করেন। এর পরই তিনি নিজ গ্রাম কালনা মহকুমার বহরাতে চলে আসেন। স্থানীয়দের কাছে আজও এই এলাকা ছাপাখানা ডাঙা নামে পরিচিত হলেও গঙ্গাকিশোরের বাস্তুভিটা কিংবা ছাপাখানার কোনও অস্তিত্ব নেই।

১৮১৯-এর এপ্রিল মাসের প্রথম ভাগে গঙ্গাকিশোর চলে এলেন কলকাতা থেকে বহু দূরে নিজ গ্রামে। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি প্রায় পুরোটাই আলোচনার বাইরে চলে গেলেন। কেন না, ১৮১৯-র এপ্রিল-পরবর্তী সময়ে তাঁর সম্পর্কে বিশেষ কিছু উল্লেখ গবেষণাপত্রগুলিতে পাওয়া যায়নি। গবেষকদের অনেকেরই ধারণা তাঁর পত্রিকা খুব সম্ভবত এক বৎসর কাল স্থায়ী হয়েছিল।

কেন ‘বঙ্গাল গেজেটি’ নামকরণ? সাময়িক পত্র গবেষক কেদারনাথ মজুমদারের মত, ‘এই বাংলা পত্রিকার নাম কেন বঙ্গাল গেজেটি-ই রাখা হয়েছিল তাহার কোনও কারণ খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। খুব সম্ভবত হিকির বেঙ্গল গেজেটে নামের প্রভাব অতিক্রম করিতে পারে নাই।’ এই মন্তব্য উল্লেখিত আছে যে গ্রন্থে সেই ‘বাঙ্গলা সাময়িক সাহিত্য’ কেদারনাথ মজুমদার প্রকাশ করেন ১৯১৮ সালে। বঙ্গাল গেজেটির প্রকাশ তারও একশো বছর আগে। আবার ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় যে সব তথ্যসূত্রের উল্লেখ করেছেন সেখানে মহেন্দ্রনাথ বিদ্যানিধি রচিত একটি প্রবন্ধের উল্লেখ করেছেন যেটি বাংলা ১৩০৪ সনের বৈশাখ সংখ্যায় ‘নব্যভারত’ মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়— ‘১২২৫ সনের ১১ জ্যৈষ্ঠ (১৮১৮, ২৩ মে) শনিবার, সমাচারপত্র বিভাগে বঙ্গভাষার দ্বিতীয় পুত্র ভূমিষ্ঠ হয়। এই সমাচার দর্পণ-এর জ্যেষ্ঠ একটি ছিল তাহার নাম বঙ্গাল গেজেটি’।

গঙ্গাকিশোর বাংলা ভাষার প্রথম সচিত্র গ্রন্থের প্রকাশক। বাংলা সংবাদপত্র এবং সচিত্র গ্রন্থ প্রকাশনা দুটোরই জনক তিনি। তবুও তাঁর সমকালে স্বীকৃতি পাননি। স্বাধীন ভারতেও তাঁকে নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে অনেক বিলম্বে। তবুও স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলার ইতিহাস লেখায় বহু প্রাবন্ধিকই উল্লেখ করেছেন তাঁর নাম। ‘কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত’তে বাংলা গ্রন্থের প্রথম প্রকাশক রূপে গঙ্গাকিশোরের নামোল্লেখ করেছেন বিনয় ঘোষ। গঙ্গাকিশোরের মৃত্যু ১৮৩১ সালে হয় বলে মনে করা হয়। যদিও কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ মেলেনি।

দুশো বছর আগে প্রকাশিত ‘বঙ্গাল গেজেটি’ কোনও সাধারণ ঘটনা নয়। বরং ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে পরাধীন ভারতে এক বাঙালি যুবকের প্রতিস্পর্ধার প্রতীক। বাংলা সংবাদপত্রের পথিকৃৎ রূপে ‘বঙ্গাল গেজেটি’ একটি যথার্থ ঐতিহাসিক মাইলফলক।

পুলক মণ্ডল কালনা, বর্ধমান

ভ্রম সংশোধন

• ‘দিব্যি আছে লন্ডন সেতু’ (১৮-৩) সংবাদে লেখা হয়েছে: ‘১৯৫২ সালে যেমন চতুর্থ জর্জের মৃত্যু সংবাদ জানানো হয়েছিল...’। চতুর্থ জর্জ নয়, ১৯৫২ সালে ষষ্ঠ জর্জের মৃত্যু হয়। এই অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আমরা দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।

• ‘সর্বত্রই ঢিলে সুরক্ষা-ফাঁস’ (‘কলকাতা’, ১৬-৩) খবরের সঙ্গে প্রকাশিত ছবিটি ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের। সেটি ভুলবশত কলকাতা মেডিক্যাল বলে প্রকাশিত হয়েছে। অনিচ্ছাকৃত এই ত্রুটির জন্য আমরা দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।

ই-মেল: letters@abp.in

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন