সম্পাদক সমীপেষু

সাধারণ মানুষের মুখে ভাষার বিকৃতি হতেই পারে। কথ্য ভাষা অর্থাৎ ডায়ালেক্ট এই ভাবেই সৃষ্টি হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলা ভাষার পণ্ডিতরা ইংরেজি ভাষার প্রতিশব্দ নির্মাণে কি খুব সফল (‘দিনে দিনে ভাষার...,’ ২১-২)? বলতে দ্বিধা নেই, আমরা অনেকেই আজও হিন্দি ভাষা সম্পর্কে নানান অপমানকর কথা বলি, অথচ অনেক ইংরেজি শব্দের হিন্দি রূপগুলো লুফে নিই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share:

থেমে গেল আমাদের বাংলা চর্চা!

Advertisement

সাধারণ মানুষের মুখে ভাষার বিকৃতি হতেই পারে। কথ্য ভাষা অর্থাৎ ডায়ালেক্ট এই ভাবেই সৃষ্টি হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলা ভাষার পণ্ডিতরা ইংরেজি ভাষার প্রতিশব্দ নির্মাণে কি খুব সফল (‘দিনে দিনে ভাষার...,’ ২১-২)? বলতে দ্বিধা নেই, আমরা অনেকেই আজও হিন্দি ভাষা সম্পর্কে নানান অপমানকর কথা বলি, অথচ অনেক ইংরেজি শব্দের হিন্দি রূপগুলো লুফে নিই।

১৯৫০-৬০’এর সময়ে যখন দোকানপাটে সিনেমা হলে ঘর ঠান্ডা করার এয়ারকন্ডিশনার বসানো শুরু হয়, তখন বাংলা কাগজের বিজ্ঞাপনে সিনেমা হল/দোকানের পাশে বন্ধনীতে লেখা থাকত একটা দাঁতভাঙা শব্দ ‘শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত’; শব্দটির হিন্দি প্রতিশব্দ চালু হলে আমরাও ব্যবহার করতে লাগলাম অনেক বেশি শ্রুতিমধুর ও সহজ উচ্চারণের ‘বাতানুকূল’। লোকসভা বা বিধানসভার সদস্য শব্দবন্ধের আমরা কোনও জুতসই বাংলা প্রতিশব্দ গঠন করতে পারলাম না যতক্ষণ না হিন্দি ভাষার পণ্ডিতরা ব্যবহার শুরু করলেন ‘সাংসদ’ ‘বিধায়ক’ শব্দগুলি। সংস্কৃত পিত্রালয় সাধু বাংলায় সরাসরি তৎসম পিত্রালয় আর চলিত বাংলায় ‘বাপের বাড়ি’ যার হিন্দি ভাবার্থ হল ‘মাইকে’। হিন্দি শব্দটির মধ্যে অনেক বেশি স্নেহপ্রবাহ ও শান্তিসুবাস জড়িয়ে আছে, তাই না?

Advertisement

অবশ্য এর উল্টো দিকও আছ; বহু ইংরেজির এমন উদ্ভট হিন্দিকরণ হয়েছিল যে হিন্দি সংবাদ-সাহিত্য নিজেরাই সেগুলি বর্জন করে ইংরেজি কথাটি দেবনাগরী হরফে লিখে থাকেন। যেমন: সিগারেট = ধূম্রনালীকা, টাইপরাইটার = টংকন, নেকটাই = কণ্ঠলেঙ্গুটি ইত্যাদি। প্রায় দশ বছর আগে এক বিজেপি সাংসদ বিদেশে মানুষ পাচারের দায়ে অভিযুক্ত হলে হিন্দি কাগজগুলোর মতো আমরাও হিউম্যান ট্রাফিকিং-এর বাংলা লিখতে লাগলাম ‘কবুতরবাজি’। খুব কি শ্রুতিমধুর? ২০১৫-য় লন্ডনে ছিলাম, ইউরোপে তখন হিউম্যান ট্রাফিকিং তুঙ্গে; প্রায় ব্রিক লেন-এর বাংলাদেশি বাজারে যেতাম বাংলা বই/পত্রিকা আনতে। সেই কাগজগুলোতে দেখতাম হিউম্যান ট্রাফিকিং-এর বাংলা লেখা হচ্ছে ‘মানব পাচার’। পশ্চিমবঙ্গীয় ভাষা ব্যবহারকারীরা একটু ভাবুন।

অনেক ভুলভ্রান্তি, গ্রহণবর্জনকে সঙ্গ করে ভারতে হিন্দি আর বাংলাদেশে বাংলা ভাষাবিদরা ইংরেজির প্রতিশব্দ গঠনের গবেষণা করে যাচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গে?

বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায়

কুলটি

সাংঘাতিক

ছেলেবেলায় অর্থাৎ ৭৫-৭৬ বছর আগে যখন মিডল ইংলিশ স্কুলের ছাত্র ছিলাম, তখন খুব, অত্যন্ত বা অত্যধিক অর্থে ভারী শব্দের প্রচলন দেখেছি। কালক্রমে গুরুভার (ওয়েটি) অর্থে ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘হেভি’ রূপে আবির্ভূত হয়ে শহর, গ্রাম নির্বিশেষে সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হয়ে সকলের মধ্যে এমন ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে, এখন তাকে হঠানো প্রায় অসম্ভব। ‘বহু ব্যবহারে সিদ্ধ’ এই রকম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ভবিষ্যতের অভিধান প্রণেতারা হয়তো ‘হেভি’কে বাংলা অভিধানে স্থান দেবেন। কিন্তু ব্যক্তিত্ব? ব্যক্তি অর্থে ব্যক্তিত্বের ব্যবহার বেশি পুরনো নয়। সংস্কৃত, ইংরেজি, বাংলা কাব্যে অচেতন পদার্থকে সচেতন রূপে কল্পনা করা হয়েছে। এখন অনেক সাংবাদিক তাঁদের প্রতিবেদনে, অনেক বক্তা তাঁদের বক্তৃতায়, অনেক লেখক তাঁদের লেখায় ‘রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব’, ‘নাট্যব্যক্তিত্ব’, ‘সংস্কৃতিমনস্ক ব্যক্তিত্ব’ প্রভৃতি শব্দবন্ধ ব্যবহার করে তাঁদের প্রতিবেদন, বক্তৃতা, লেখাকে সমৃদ্ধ করে তুলছেন। বিংশ শতাব্দীর বা তারও আগেকার সময়ে আমরা যাঁদের ‘রাজনীতিবিদ’, ‘নট/অভিনেতা’ বা ‘সংস্কৃতিমান’ বলে মনে করতাম অর্থাৎ যে সমস্ত গুণ বা কার্যকলাপের মাধ্যমে যাঁরা রাজনীতিবিদ, নট/অভিনেতা, সংস্কৃতিবান বলে পরিচিতি পেতেন, এখন সেই সকল গুণের জন্যই তাঁরা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, নাট্যব্যক্তিত্ব, সংস্কৃতিমনস্ক ব্যক্তিত্ব রূপে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। এতে কি তাঁদের মর্যাদা বেড়েছে? ব্যাকরণের নিরিখে ‘ব্যক্তিত্ব’ শব্দ গুণবাচক বিশেষ্য। যেহেতু গুণবাচক শব্দ অতএব নিরাকার। সেই নিরাকার-এর ‘মন’ বলে একটা ইন্দ্রিয়ের অস্তিত্ব এবং সেই ইন্দ্রিয়ের সংস্কৃতিমনস্ক হওয়া কতটা বাস্তবসম্মত সেটা বিচার্য।

‘সংঘাত’ বা ‘জীবননাশ’ মূলক কোনও কারণ কোনও ঘটনার মূলে না থাকা সত্ত্বেও সেই সব ঘটনাকে আমরা অবলীলাক্রমে ‘সাংঘাতিক’, ‘মারাত্মক’ বলে বর্ণনা করে থাকি। সম্প্রতি সন্ধ্যার টিভি সিরিয়ালের একটি অনুষ্ঠানের সঞ্চালিকা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী এক মহিলার একটি বিশেষ কৃতিত্বকে প্রশংসা করে বললেন, ‘সাংঘাতিক ব্যাপার’। ওই অনুষ্ঠানের অংশগ্রহণকারী অপর এক মহিলা একটি ঘটনা বর্ণনা করে বললেন ‘সাংঘাতিক ঘটনা’। সংঘাতের কোনও চিহ্ন ছিল না, তবুও সাংঘাতিক রূপে চিহ্নিত হল।

অবনীরঞ্জন পাণ্ডে

গুসকরা, বর্ধমান

আমরা অভিভূত

একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষাদিবসে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ভাষা শহিদ মিনারে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করার বাসনা নিয়ে ১২ দিনের ট্যুর প্রোগ্রামে শামিল হই। ভ্রমণের শেষ পর্যায়ে যখন রাঙামাটি থেকে ফিরতি যাত্রা করি তখন রাঙামাটি-চট্টগ্রাম বর্ডার চেকপোস্টে আমাদের ৩৪ জন ভারতীয় পর্যটকের বাসটিকে চট্টগ্রামের দিকে এগোতে বারণ করে। কারণ, এক গাড়ি দুর্ঘটনায় মহিলার মৃত্যুতে বাংলাদেশের কোর্ট যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন সংশ্লিষ্ট গাড়ির ড্রাইভারকে। এর প্রতিবাদে সমগ্র বাংলাদেশের পরিবহণ কর্মীরা অনির্দিষ্ট কালের জন্য পথ অবরোধ শুরু করেন।

আধ ঘণ্টার মধ্যে ক্লিয়ারেন্স পাবার পর চেকপোস্ট থেকে আমাদের বাস চট্টগ্রামের পথে রওনা দেয়। চট্টগ্রামের জংশনের কাছে অবরোধকারীরা আমাদের বাসের সামনে একটি বড় কন্টেনার-লরিকে আড়াআড়ি ভাবে রেখে রাস্তা আটকে দেয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মুহূর্তের মধ্যে স্থানীয় থানার ওসি এসে আমাদের বাসটিকে ছেড়ে দিতে বলেন। তাতে কাজ না হওয়ায় এসপি সাহেব নিজে ‘র‌্যাফ’ নিয়ে স্পটে এসে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। অল্প কিছু সময় পরে অবরোধকারীরা সরে যায় এবং সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী ভরা একটি পাইলট-কার সাইরেন বাজিয়ে জ্যাম সরাতে সরাতে আমাদের বাসের আগে আগে ছুটতে থাকে। ৩/৪ কিমি যাবার পর দেখা যায় রাস্তার পাশে নতুন একটি সশস্ত্র পুলিশ ভরা পাইলট-কার আমাদের বাসের দায়িত্ব নিয়ে আগে আগে ছুটতে থাকে সাইরেন বাজাতে বাজাতে।

এই ভাবে ঢাকা শহর পর্যন্ত প্রায় ২৮০ কিমি পথে যে যে থানা পড়েছে, তারা রিলে সিস্টেমে পাইলট-কার রেডি রেখে আমাদের বাসটিকে ঢাকা শহরে আমাদের হোটেলে পৌঁছে দিয়েছে। চলার পথে আমাদের বাসের ভেতর ট্যুর গাইডকে বার বার ফোন করে ঢাকার কেন্দ্রীয় পুলিশ কন্ট্রোল থেকে জানতে চেয়েছে কোনও অসুবিধা হচ্ছে কি না। পরের দিন সকালে আমরা তৈরি হওয়ার আগেই আমাদের হোটেলের সামনে সশস্ত্র পাইলট-কার মোতায়েন হয়ে যায়। স্থানীয় থানার মহিলা ওসি নিজে এসে হোটেলে বসে আমাদের রুট ঠিক করে দেন।

আগের দিন ১৮টি থানার ১৮টি পাইলট-কার তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। আজ আমাদের গন্তব্য ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া ২৫৩ কিমি আর কুষ্টিয়া থেকে বেনাপোল ১৩০ কিমি। পথে ১৫টি থানা সেই মতো নির্দেশ পালন করে এবং পাইলট-কার আমাদের নিরাপত্তা দিয়ে নিয়ে যায়। লালন শা’র মাজারে বাউল গানের আসরের চারিদিকে আর শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ির ঘরে ঘরেও বাংলাদেশ পুলিশ অফিসার আমাদের সব সময় নজরে রেখেছেন আর ঢাকা কন্ট্রোল রুম থেকে ওয়াকিটকিতে ক্ষণে ক্ষণে খবর পাঠিয়েছে সব ঠিক আছে। পদ্মা পার হওয়ার সময় ভেসেলে রাত্রিতেও পুলিশ পাহারা ছিল, ছিল মহিলা পুলিশ সহ। বাংলাদেশের প্রশাসনের তৎপরতা ও ভারতীয়দের প্রতি মনোযোগ দেখে আমরা অভিভূত। প্রতি পদে নিজেদের ভিআইপি মনে হচ্ছিল।

প্রবীরকুমার মৈত্র

কল্যাণী, নদিয়া

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।

ই-মেল: letters@abp.in

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন