সম্পাদক সমীপেষু

উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন জাতি-ধর্ম-বর্ণে চলে আসা বিভেদের রাজনীতির সামনে বিপন্ন প্রশ্নচিহ্ন খাড়া করেছে। এই নির্বাচনে আঞ্চলিক দলগুলির পরাজয় বলে দিচ্ছে যে আমাদের গণতন্ত্র অনেক পরিণত হচ্ছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share:

গণতন্ত্র কি পরিণত হচ্ছে

Advertisement

উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন জাতি-ধর্ম-বর্ণে চলে আসা বিভেদের রাজনীতির সামনে বিপন্ন প্রশ্নচিহ্ন খাড়া করেছে। এই নির্বাচনে আঞ্চলিক দলগুলির পরাজয় বলে দিচ্ছে যে আমাদের গণতন্ত্র অনেক পরিণত হচ্ছে। জাতিধর্মের গণ্ডি পেরিয়ে মানুষ রাজনীতিকে রাজনীতি হিসাবে দেখছেন। বিজেপির উন্নয়নের স্লোগান বাকি সব স্লোগানকে স্তিমিত করে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই সঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন যে, নির্বাচনী রাজনীতির সবটা কিন্তু স্লোগান দিয়ে হয় না। এ দেশের মানুষ এতটা রাজনৈতিক নিরক্ষর নন যে, শুধু স্লোগান দিয়ে তাঁদের আস্থাকে ব্যালটে রূপান্তরিত করা যায়। নিঃসন্দেহে বিমুদ্রাকরণ নিয়ে বিজেপি নিজের মতো বুঝিয়েছে, কিন্তু অখিলেশ-মায়াবতীর বোঝানো কেন মানুষ প্রত্যাখ্যান করল?

আসলে যে যা-ই বোঝাক, দলিত মানুষ কিন্তু বিমুদ্রাকরণকে ধনিক শ্রেণির বিরুদ্ধে সামাজিক লড়াই হিসাবে নিয়েছে। মেরুকরণ ধর্মের না হয়ে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিতের ভিত্তিতে হয়েছে। বিরোধীরা মেরুকরণের এই নয়া প্রক্রিয়া নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন না। শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায় মুসলিম প্রতিনিধিত্বের হ্রাসমান সংখ্যাটার দিকে তাকিয়ে আশঙ্কিত হয়ে মন্তব্য করেছেন, এটা ‘গণতন্ত্রের পক্ষে ক্ষতিকারক’ (‘হিন্দু রাষ্ট্র তৈরির জন্য এখনও অনেক রাস্তা বাকি’, ১৪-৩)। কিন্তু নির্বাচন তো ধর্মীয় বা সম্প্রদায়গত প্রতিনিধিত্বের জন্য নয়। আর প্রার্থী সমাজের কোন সম্প্রদায়ের হবেন, নির্ণয় করে রাজনৈতিক দলগুলি। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলিকে ভাবতে হবে যে তারা দলের নীতি, আদর্শ ও ইস্তেহারে জোর দেবে, না কি জাতি সম্প্রদায়ের টোটকায় বিশ্বাস রাখবে। এই নির্বাচন আঞ্চলিক রাজনৈতিক এজেন্ডাকে প্রত্যাখ্যান করে। আঞ্চলিক শক্তির অস্তিত্বকে পেছনে ফেলে ‘প্যান-ইন্ডিয়া’র ধারণাগত রাজনৈতিক উত্তরণ ঘটছে। মানুষ কূপমণ্ডূকতা থেকে বেরিয়ে আসছে। রাজ্যের দলিত রাজনীতি চিন্তাভাবনায় সাবালক।

Advertisement

এত দিন উত্তরপ্রদেশে দলিতদের নিয়ে পঙ্কিল রাজনীতি হয়েছে। আজ সেই অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। ভারতে দলিত, সংখ্যালঘু, উচ্চবর্ণ এবং এদের উপবিভাগগুলি রাজনৈতিক প্রয়োজনে চিরস্থায়ীকরণের চেষ্টা হয়েছে রাজনৈতিক লাভ-লোকসানের হিসেবে। বিভক্ত সেই সমাজ এত দিন একে অপরকে শ্রেণিশত্রু ভেবেছে। রাজনৈতিক দলগুলি জাতিধর্মের পৃষ্ঠপোষণ করেছে। এই নির্বাচন রাষ্ট্রীয় জীবনে রাজনীতির ঊর্ধ্বে সমাজজীবনের মূলস্রোতে অঙ্গীভূত হওয়ার ইঙ্গিত দেয়। এ অঙ্গীকার হিন্দুত্ববিরোধীদের কাছে দুঃসংবাদ, কারণ বিভক্ত হিন্দুসমাজ ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। ভারত হিন্দুরাষ্ট্র হবে কি না, দেশের একশো তিরিশ কোটি মানুষ তা ঠিক করবেন।

সুব্রত পাল নাটনা-করিমপুর, নদিয়া

ভোলা যায় না

উত্তরপ্রদেশে ‘ইলেকশন ওয়াচ অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস’ (এডিআর)-র প্রকাশিত সমীক্ষা অনুসারে, উত্তরপ্রদেশে বিধানসভার নবনির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে ৩২২ জন বিধায়ক কোটিপতি, ১৪৩ জনের বিরুদ্ধে খুন-ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের মামলা রয়েছে। অর্থাৎ প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৮ জনই কোটিপতি। এর পাশাপাশি, প্রতি চার জন নবনির্বাচিত বিধায়কের মধ্যে এক জনের বিরুদ্ধেই খুন বা ধর্ষণের মতো গুরুতর মামলা রয়েছে। এ বারের বিধানসভায় গতবারের (২০১২) তুলনায় কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩২২ জন বা ৮০ শতাংশ। গত বার এই সংখ্যা ছিল ২৭১ (৬৭ শতাংশ)। বিধায়কদের গড় সম্পদের পরিমাণ ৫.৯২ কোটি টাকা। যে ৯২ জন বিধায়ক ফের জিতেছেন তাঁদের গড় সম্পদের পরিমাণ ২০১২-র ৪.৬২ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৮.৬২ কোটি টাকা। ১৪৩ জন বিধায়ক (মোট বিধায়কদের ৩৬ শতাংশ) তাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রয়েছে। আট বিধায়ক তাঁদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা ও ৩৪ জন বিধায়ক তাঁদের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার অভিযোগ থাকার কথা ঘোষণা করেছেন। সমীক্ষা অনুসারে, বিজেপির সবচেয়ে বেশি ৮৩, সপা-র ১১, বিএসপি-র চার, কংগ্রেসের ১ এবং তিন নির্দল বিধায়ক তাঁদের হলফনামায় তাঁদের বিরুদ্ধে গুরুতর ফৌজদারি অপরাধের মামলার কথা জানিয়েছেন।

স্বচ্ছ ভারত মানে কি শুধু রাস্তাঘাট পরিষ্কার? যাঁরা দেশ চালকের আসনে স্ব-মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেম, তাঁদের মধ্যে স্বচ্ছতা কোথায়? গরিব মানুষের কথা বলে ভোটে জেতা নির্বাচিত এমএলএ/এমপিদের সম্পত্তি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে কী করে? এঁরা কি গরিবের প্রতিনিধি হতে পারেন? এক দলের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে অন্য আর একটা দলকে ক্ষমতায় আনবার সময় আমরা যদি সূক্ষ্ম ভাবে এর বিচার না করি, তা হলে গণতন্ত্রের ভেকধারীরা বার বার ঠকাবেই। তাঁতের মাকুর মতো এক বার এ দিক আর এক বার ও দিকে কেবল ঠোক্কর খেতেই থাকব আমরা। সত্য কি সব সময় সংখ্যা দিয়ে যাচাই করা যায়? বিপুল ভোটে যে-ই জিতুক না কেন, আমরা কি এই দিকগুলি ভুলে যেতে পারি?

কিংকর অধিকারী বালিচক, পশ্চিম মেদিনীপুর

হাহুতাশ কেন

শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, রাজ্যের (উত্তরপ্রদেশ) জনসংখ্যার ১৯ শতাংশ মুসলিম হলেও তাদের প্রতিনিধিত্ব ৬ শতাংশ নেমে এল। এটা গণতন্ত্রের পক্ষে ক্ষতিকারক সন্দেহ নেই (‘হিন্দু রাষ্ট্র তৈরির জন্য এখনও অনেক রাস্তা বাকি’, ১৪-৩)। রাজ্যের দলিত জনসংখ্যারও যথার্থ প্রতিনিধিত্ব হয়নি, মহিলাদেরও যথার্থ প্রতিনিধিত্ব হয়নি। উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা ভোটে উত্তরপ্রদেশের ‘মানুষ’ ভোট দিয়েছেন। এটাই কি গণতন্ত্রের পক্ষে সর্বাপেক্ষা কাঙ্ক্ষিত অবস্থা নয়? জাতপাত ও আত্মপরিচয়ের রাজনীতিই তো ভারতীয় গণতন্ত্রের পূর্ণতা প্রকাশের পরিপন্থী। তার জন্য বুদ্ধিজীবীদের এত হাহুতাশ কেন?

মধুসূদন সাহা কলকাতা-৫২

আর কেউ নেই

বিজেপির এই নির্বাচন জয় নিঃসন্দেহে এক নতুন অধ্যায় খুলে দেবে, এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। বর্তমান ভারতীয় রাজনীতিতে সেই অধ্যায় কতটা সুখের, সে কথা অন্তত ৫০% ভারতীয়ও হলফ করে বলতে পারবে না। কথায় আছে, ‘ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়’। আসলে, আমাদের দেশের সরকার এবং দল খুব সুন্দর বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে যায়। মোদ্দা কথা, যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারে। নোট বাতিল নিয়েও কেউ কিচ্ছু করতে পারেনি। এর ফলে কী লাভ-ক্ষতি হল কেউ জানে বলেই আমার মনে হয় না (‘তিন বছর পর এই সাফল্য...’, ১৫-৩)। সরকার ধরে রাখতে কিংবা বিল পাশ করতে যা যা করার তা-ই করব— এই মানসিকতা নিয়ে যদি সরকার চলে তার পরিণাম কয়েক বছর পর জানা যাবে।

তবে বিগত কয়েকটা নির্বাচনে এটা প্রমাণিত যে, বহুদলীয় শাসনব্যবস্থা থেকে দ্বিদলীয় শাসনব্যবস্থার দিকে আমরা ঝুঁকছি। হয় কংগ্রেস অথবা বিজেপি। মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, উত্তরপ্রদেশ অথবা মণিপুরে তা প্রমাণিত। সেই দিকটা ভাবলে ভাল লক্ষণ মনে হতে পারে।

বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার আগামী এক বছর নোট বাতিলের মতো আরও কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সেই সব সিদ্ধান্তে নিম্নমধ্যবিত্ত লোকের কতটা উপকার বা সাহায্য হবে বলা খুব দুষ্কর। এটা বলা যেতেই পারে, কঠিন সময় আসছে। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ হয়তো হবে না, কিন্তু সাধারণ মানুষের পকেট কাটবে, এটা অন্তত নিশ্চিত। সরকার রাজকোষ বাড়ানোর জন্য এমন অনেক সিদ্ধান্ত নেবে, যেটা সবার মেনে নিতে কষ্ট হবে, কিন্তু সাহায্য করার কেউ থাকবেই না, কারণ বিরোধী দলগুলো বেশি দূর যেতে পারবে না!

নিলয় মোদক কলকাতা-৫৯

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।

ই-মেল: letters@abp.in

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন