কর্পোরেটে বিচক্ষণতার দাম নেই
সন্দীপ মিত্রর ‘স্বাস্থ্যে কিন্তু কর্পোরেটই ভরসা’ (১০-৫) পড়ে আমার মনে হয়েছে, চিকিৎসাশাস্ত্রে কুশলতার ব্যাপারটি সম্পর্কে তাঁর ধারণাটি শুধুমাত্র ভ্রান্তই নয়, বিপজ্জনকও বটে! চিকিৎসকের কুশলতা সম্পর্কে তিনি সম্ভবত দ্রুততার সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কথাই বলতে চেয়েছেন, যা সচরাচর কর্পোরেটেই হয়ে থাকে। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সুফলের পাশাপাশি কুফলগুলির বিষয়ে ধারণা না থাকলে সমূহ বিপদ। এক জন চিকিৎসকের দক্ষতা শুধুমাত্র তাঁর আধুনিক প্রযুক্তিজ্ঞান দিয়ে নির্ধারণ করা যায় না, সেটি নানাবিধ গুণের সমন্বয়। তাই রোগের মোকাবিলায় ক্লিনিকাল বিচক্ষণতা ও প্রযুক্তি ব্যবহারের সামঞ্জস্য না থাকলে চলবে না। সমস্যা সেখানেই। সরকারি, বেসরকারি— দু’ক্ষেত্রেই এই সামঞ্জস্যের বড় অভাব।
বেসরকারি হাসপাতালের ক্ষেত্রে অনেকেই আছেন যাঁরা ডাক্তারের নাম, ডিগ্রি, সাফল্য হার ইত্যাদি ভাল করে না জেনেই শুধুমাত্র বিজ্ঞাপন দেখে প্রভাবিত হন এবং প্রতিষ্ঠানের নামটাই সেখানে প্রাধান্য পেয়ে থাকে। কর্পোরেট হাসপাতালগুলোই একমাত্র ভরসার জায়গা হলে আর এই লক্ষ লক্ষ রোগী, যাঁরা প্রতিনিয়ত সরকারি হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসাধীন, তাঁদের কোনও ভরসার জায়গা নেই বললে তা মারাত্মক মিথ্যা রটনা হবে। প্রতিযোগিতার বাজারে করে খাওয়ার বিষয়টি গ্রামগঞ্জ মফস্সলের ছোট স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলির ক্ষেত্রে আংশিক সত্য হলেও কর্পোরেট হাসপাতালগুলোর ক্ষেত্রে একদমই প্রযোজ্য নয়। এগুলির ক্যাচমেন্ট এলাকা বিশাল, সঙ্গে আছে মেডিক্লেমের ব্যাপার (ব্যতিক্রম, ইনফার্টিলিটি ক্লিনিক)। আমার মেডিক্লেম থাকলেও একান্ত নিরুপায় না হলে কর্পোরেট হাসপাতালে সরাসরি ভর্তি হওয়ার আগে অন্তত বার দশেক ভাবব। প্রথমত, খরচ। দ্বিতীয়ত, তৃতীয়ত আরও অনেক কিছু। বহু রোগী কর্পোরেটে ভর্তি থেকে কপর্দক শূন্য হয়ে পড়লে তাদের একমাত্র ভরসা সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ। এক জায়গায় ভেন্টিলেটর খুলে অন্য জায়গায় ভেন্টিলেটরে সংযোগের কাজটা সহজ নয় মোটেও। যে সব রোগের বিশেষ হইচই করে চিকিৎসা করার অবকাশ চিকিৎসাশাস্ত্রেই নেই, সেখানে মেশিনে-মানুষে যুদ্ধ বাঁধানোরও মানে নেই। খামোকা পার্থক্য সৃষ্টির দরকার নেই সরকারি ও বেসরকারি ডাক্তারদের মধ্যে।
আজকে এ দেশে চিকিৎসা-সহ সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থায় সব থেকে বড় সংকট হল মৌলিক গবেষণার অভাব। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাদা চামড়ার উপর গবেষণালব্ধ ফল থেকে তৈরি করা প্রোটোকল অনুযায়ী চিকিৎসা চালাতে হয় কালো চামড়ার উপর যাঁদের জেনেটিক গঠন থেকে শুরু করে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি পর্যন্ত অনেকাংশেই আলাদা। চিকিৎসক অনেক সময় নানা কারণে প্রোটোকল ভাঙতে বাধ্য হন। মুমূর্ষু রোগীটিকে বাঁচাতে অনেক সময়ই তা চিকিৎসকের দীর্ঘ অভিজ্ঞতালব্ধ প্রত্যয় বলা যায়। এক জন চিকিৎসকের সাফল্য কিন্তু সেখানেই যে তিনি কত কম চিকিৎসাজনিত ব্যয়ে রোগীকে তার সর্বোৎকৃষ্ট পরিণাম দিতে পারছেন। হয়তো তিনি ছাত্রজীবনে শেখা ন্যূনতম খরচের একটি বুদ্ধিদীপ্ত পুরনো বেডসাইড প্রক্রিয়া ব্যবহার করলেন তাঁর কোনও গরিব রোগীর জন্য। এটাই চিকিৎসকের সূক্ষ্ম বিচক্ষণতা। কর্পোরেট ব্যবস্থায় এই বিচক্ষণতার কোনও মূল্য নেই। চিকিৎসক মাসের শেষে কাঙ্ক্ষিত আর্থিক লক্ষ্যমাত্রা কর্পোরেটের হাতে না তুলে দিলে তাঁর চাকরি নিশ্চিত থাকবে তো? সুতরাং নানাবিধ সামাজিক ফ্যাক্টরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার ব্যাপারটা এত সহজ নয়।
ইন্দ্রনীল ঠাকুর অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর (মেডিসিন), কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ
প্রতিবেদকের উত্তর: মন্ত্রী-আমলারা, নেতারা, এমনকী বেশির ভাগ ডাক্তার চিকিৎসার জন্য কোন হাসপাতালে যান— সরকারি, না বেসরকারি? ভরসা তো সেখান থেকেই তৈরি হয়। আমার লেখায় সরকারি ডাক্তারদের দক্ষতার অভাব প্রমাণের কোনও চেষ্টা ছিল না। বরং, সরকারি হস্তক্ষেপে কী ভাবে একটা গোটা ব্যবস্থা অকুশলী হয়ে পড়ে, আমি সে কথা বলতে চেয়েছিলাম। তাতে ডাক্তারদের দায় সামান্যই।
অর্থনীতিবিদ হিসেবে আমি মনে করি, কোনও একটি পরিষেবার জন্য মানুষ কতখানি টাকা খরচ করতে রাজি আছেন, সেটা সেই পরিষেবার গুণগত মানের একটা গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক। মানুষকে বোকা ভাবার মানে হয় না। যে স্বাস্থ্য পরিষেবা সরকারি হাসপাতালে অনেক কম খরচে পাওয়া সম্ভব, বেসরকারি জায়গায় যখন মানুষ তার জন্যই বেশি টাকা খরচ করে, তখন বোঝা যায়, দুই ক্ষেত্রে পরিষেবার গুণগত মানের ফারাক থাকতে বাধ্য। শুধু বিজ্ঞাপন দেখেই রোগীরা আসেন, এমন ভাবনার মধ্যে অহেতুক সরলীকরণ রয়েছে।
রাজ্যের বিভিন্ন মাপের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে কী ধরনের স্বাস্থ্য পরিষেবার পরিকাঠামো রয়েছে, কোথায় কোন কোন রোগের চিকিৎসা হয়, সে বিষয়ে একটি বিস্তারিত নথি তৈরি করা গেলে এই বিতর্কের তথ্যনির্ভর উপসংহারে পৌঁছনো সম্ভব বলে মনে করি।
ধর্ম-ব্যবসা
মিলন দত্তর লেখা (‘কোনও ধর্মেরই উচিত নয়...’, ৬-৫) আমাদের ভাবিয়ে তোলে। সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু বাঙালি আজ ধর্মকে বিনোদন ও ‘অন্যের থেকে আমাদেরটা ভাল’ এই তত্ত্বের দিকে নিয়ে যেতে চাইছে। মসজিদে মাইকে আজান, মিলাদ মহফিলে মাইক, পুজো প্যান্ডালে চটুল গান-সহ নৃত্য, বছর চল্লিশ আগেও ছিল না। এগুলি এসেছে বিনোদন-সহ ধর্মীয় আধিপত্যবাদ থেকে। এর পিছনে রয়েছে ভোটসর্বস্ব রাজনীতি।
ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা খোমেইনি সেই আশির দশকেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ইসলাম ইজ নাথিং বাট পলিটিক্স’। বিজেপির রামমন্দিরের শিলান্যাস, বাবরি মসজিদ ধ্বংস, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বিতর্ক থেকে হিন্দু মৌলবাদের বাড়বাড়ন্ত। পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু মানসিকতা তখন থেকেই ফিসফাস শুরু করেছিল। তা কখনও কমেছে কখনও জোয়ারের স্রোতে ভেসেছে। ভেতরের সুপ্ত আগুনে ইন্ধন দিয়েছে সিপিএম এবং তৃণমূলের ভুল নীতি। দুটি দলের কোনও কার্যক্রমে সংখ্যালঘু মুসলমানদের কোনও সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেনি। উন্নয়ন যা হয়েছে, তা হিন্দু-মুসলিম সব সমাজে। পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, বার্ধক্য ভাতা, বিভিন্ন প্রকল্পে গৃহ নির্মাণ, সামান্য চাকরিবাকরি— সব সমাজই পেয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন দশ হাজার মাদ্রাসাকে তালিকাভুক্ত করলেন, তখন এ বাংলার হিন্দুসমাজ সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ আনল। যদিও মাদ্রাসা তালিকাভুক্ত করে না-হল তার পাঠ্যক্রমে কোনও উন্নয়ন, না-হল খারিজি মাদ্রাসার শিক্ষকদের ভদ্র বেতন কাঠামো। কিন্তু এই ঘোষণা গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল হিন্দু মানসিকতায়।
আনন্দবাজারে বেশ কয়েকটি উত্তর-সম্পাদকীয় নিবন্ধে সেমন্তী ঘোষ সাম্প্রদায়িকতা নিরসনে সমাজে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিসর নির্মাণ করে পারস্পরিক আলোচনার কথা বলেছিলেন। আজ বোধ হয় সেই সময় এসেছে। প্রয়োজন পারস্পরিক আলোচনা ও ধর্মনিরপেক্ষতার অনুশীলন। সংবিধানের পাতায় যা রয়েছে তাকে বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব উদারপন্থী হিন্দু-মুসলিম সমাজকে নিতে হবে।
ধর্ম যখন ক্ষমতায় আসার, আধিপত্য ও অর্থ উপার্জনের মাধ্যম তখন তাকে নিঃশব্দ রাখলে ধর্ম-ব্যবসায়ীদের ক্ষতি। মিলন দত্ত ঠিকই লিখেছেন, কয়েকটি ধর্মীয় উপ-সম্প্রদায় বাদ দিলে আধুনিক কালে ধর্ম ব্যক্তিগত মগ্নতার বিষয় ছিল না, আজও নেই। তার সঙ্গে যোগ করি, ধর্মীয় সমালোচনার বিষয়টিও নিঃশেষিত প্রায়। আসলে, ধর্মব্যবসায়ী ও আধিপত্যবাদীদের সমালোচনা অর্থেই বর্তমান সময়ে ধর্মের সমালোচনা বলে প্রচার করা হয়। সাধারণ মানুষ এমন প্রচারে প্রভাবিত হন খুব তাড়াতাড়ি।
সৈয়দ আলাওল শ্রীপুর, বর্ধমান
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।
ই-মেল: letters@abp.in