সম্পাদক সমীপেষু

যিনি আওয়াজটা তুলেছিলেন তাঁর প্রত্যাশা ছিল মোটামুটি ভরা হলটির কোনা কোনা থেকে উত্তর আসবে ‘জয়’। কিন্তু উত্তর এল খুবই ক্ষীণ ভাবে। দেখলাম, গান এবং স্লোগানের আওয়াজটি যাঁদের, তাঁরা ২৮-৩০ বছরের দু’জন যুবক। ‘জয়’ স্লোগানটি প্রত্যাশার ধারে কাছে না হওয়ায় ওদের এক জনের মন্তব্য, ‘ইধার সব পাকিস্তানি হ্যায় ক্যায়া?’

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৭ ০০:০০
Share:

দেশপ্রেম কি জয়!

Advertisement

এক অভিজ্ঞতা জানাই। সম্প্রতি দক্ষিণ কলকাতার একটি মল-এর সিনেমা হলে একটি চলচ্চিত্র দেখতে গিয়েছিলাম। আমার বসার জায়গাটা ছিল ঠিক প্রবেশ পথের ধারে। একটু পরেই পাশের তিনটে আসনে এসে বসল বছর কুড়ির তিনটি মেয়ে। যথাসময়ে শুরু হল জাতীয় সংগীত। তাকে সম্মান জানাতে যখন উঠে দাঁড়িয়েছি, সেই সময় প্রবেশ পথের ধারে এসে দাঁড়াল কেউ বা কারা। সংগীত চলাকালীন তার সঙ্গে গলা মেলানো পুরুষ কণ্ঠের আওয়াজ ভেসে এল আমার পাশটি থেকে। গান শেষ হতে সেখান থেকেই আওয়াজ উঠল ‘ভারত মাতা কি’।

যিনি আওয়াজটা তুলেছিলেন তাঁর প্রত্যাশা ছিল মোটামুটি ভরা হলটির কোনা কোনা থেকে উত্তর আসবে ‘জয়’। কিন্তু উত্তর এল খুবই ক্ষীণ ভাবে। দেখলাম, গান এবং স্লোগানের আওয়াজটি যাঁদের, তাঁরা ২৮-৩০ বছরের দু’জন যুবক। ‘জয়’ স্লোগানটি প্রত্যাশার ধারে কাছে না হওয়ায় ওদের এক জনের মন্তব্য, ‘ইধার সব পাকিস্তানি হ্যায় ক্যায়া?’ তবে আসল ঘটনা ঘটল বিরতির ঠিক পরেই।

Advertisement

ওই দুই যুবক বসেছিল আমার তিনটি মেয়ের ঠিক পাশেই। বিরতি হতেই দেখলাম ওরা উঠে বাইরে চলে গেল। খানিক পরেই মেয়ে তিনটির এক জন আমাকে কুণ্ঠাভরা প্রশ্ন করল: ‘আপনি যদি আপনার সিটটা আমাদের ছেড়ে এ দিকে আসেন, খুব অসুবিধা হবে কি?’ বুঝতে অসুবিধা হল না ওদের বিড়ম্বনার কথা। আমি নিঃশব্দে জায়গা ছেড়ে সেই যুবকদের পাশের আসনে বসে পড়লাম।

মেয়ে তিন জন যখন আমাকে— অকারণই— ধন্যবাদ জানাতে ব্যস্ত, সেই সময় ফিরে এল ওরা দু’জন। বসার জায়গাটা যে ভাবে পালটাপালটি হয়ে গেছে, তা দেখে হলের আধো অন্ধকারেও ওদের শরীরে হতাশার ভাষাটা পড়ে নিতে একটুও বেগ পেতে হল না।

প্রেমাংশু দাশগুপ্ত

কলকাতা-৩৪

গোর্খাল্যান্ড

এক মাসেরও বেশি রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূখণ্ড সম্পূর্ণ অচল। জীবনধারণের সব দিক প্রায় অবরুদ্ধ। কার্যত এখানকার মানুষের জীবন, জীবিকা ও সম্পদকে বাজি ধরে চলছে গোর্খাল্যান্ড আদায়ের আন্দোলন। ইতিমধ্যে প্রভূত সরকারি সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে মানবসম্পদের।

দার্জিলিং আমাদের প্রাণের আরাম বটে, কিন্তু আত্মার শান্তি কি? সমতলবাসী ও বঙ্গভাষীরা সুযোগ পেলেই দার্জিলিং গিয়ে একটু ‘রিফ্রেশড’ হয়ে নিই। তার পর ‘আমাদের দার্জিলিং’ নিয়ে বুক ফুলিয়ে ফেসবুকে ছবি আর স্টেটাস পোস্টাই। কিন্তু একটু অন্য চোখে দেখলে হয়তো টের পেতাম দার্জিলিং কেন মাঝে মাঝে প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ হয়ে ওঠে।

এখানে জীবন প্রতি পদক্ষেপে অসম্ভব দুর্মূল্য ও ঝুঁকির। পরিবহণ ও স্বাস্থ্য পরিষেবা নিজেই রুগ্‌ণ। চা শ্রমিকদের জীবনচর্যা কী ভয়াবহ, তা সুখী পর্যটকের চোখে ধরা পড়বে না। আসলে ঔপনিবেশিক মন থেকেই আমরা দার্জিলিং পাহাড়ের রূপ দেখি এবং তার অধিবাসীদের দিকে কৃপাদৃষ্টিতে তাকাই। এই জন্যই এক সমাজবীক্ষক প্রায়শ্চিত্তের ভাষাভঙ্গিতে একুশ শতকের বাঙালি বাবুবিবিদের কলোনিয়াল সেন্টিমেন্টের হ্যাংওভার ঠিক ভাবেই আবিষ্কার করেন, “পাহাড়ের মানুষ মানেই সরল (পড়ুন: বুদ্ধিহীন), আবেগপ্রবণ (পড়ুন: রগচটা), সাদাসিধে (পড়ুন: অল্পে খুশি) ও অনুগত (পড়ুন: প্রশ্ন করে না, সহজে বশ্য, গৃহপালিত পশুর মতো)— সমতলের বাঙালির এই ধারণাগুলো শাসকের মতো, প্রতিবেশীর মতো নয়। এই ধারণার চাষ হতে দেখেছি প্রশাসন থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরে। এই চাষ থেকে উঠে এসেছে যে ফসল তার নাম: ক্ষোভ।” (দার্জিলিং: স্মৃতি সমাজ ইতিহাস, পরিমল ভট্টাচার্য, অবভাস, ২০০৯)

দার্জিলিঙের পার্বত্য মানুষের গঠন, খাদ্য, ভাষা, সংস্কৃতি— কিছুই সমতলের বাঙালি জীবনচর্যার সঙ্গে মেলে না। এই গোর্খা কারা? সাধারণ ভাবে পাহাড়ে বসবাসকারী নেপালিভাষী জনসাধারণকেই বাঙালিরা গোর্খা মনে করেন। কথিত আছে, নেপালের এক পর্বতগুহায় গোরক্ষনাথ সাধনা করতেন। তাঁরই শিষ্য ও উপাসক হিসেবে এই ভূখণ্ডের ঠাকুর, খাস, মঙ্গর, ও গুরুঙ্গরা নিজেদের গোর্খা বা গোর্খালি বলে পরিচয় দিতেন।

দার্জিলিঙের ‘নেপালি’রা আসলে বহু উপজাতীয় মানবধারার মিলনে সৃষ্ট বর্তমানে সংহত একটি মানবসমাজ; যাঁদের ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার রয়েছে। মূলত নেপাল, সিকিম, ভুটান ও মধ্য-পূর্ব তিব্বতের নেপালিভাষী মানুষই দীর্ঘকাল এখানে বসবাস করছেন। সংস্কৃতজ হিন্দি প্রভাবিত নেপালি ভাষাই দার্জিলিঙের মাতৃভাষা। নেপালি ভাষা মানেই কিন্তু নেপালের ভাষা নয়। এই ভাষাটি বর্তমানে সাহিত্য সৃষ্টির দিক থেকে এবং যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বেশ সমৃদ্ধ। নেপালের প্রাচীন রাজপুত বংশের উত্তরাধিকারীরা গোর্খা শহরে এসেছিলেন। গোর্খাধীপ পৃথ্বীনারায়ণ শাহ্‌ নেপালে রাজনৈতিক ঐক্যপ্রতিষ্ঠার অন্যতম স্থপতি। তারও আগে নেওয়া-র রাজা জয়প্রকাশ মল্ল-র সময়েও নেপালি ভাষার প্রচলন ছিল। গোর্খারা এই ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেন। নেপালি ভাষার নাম হয় গোর্খালি।

গুরুঙ্গ, রাই, তামাঙ্গ এগুলি এক একটি জনজাতি বিশেষ। গুরুঙ্গরা ‘ঘোলে’, রাইরা ‘থুলুঙ’, তামাঙ্গরা ‘ঘিসিঙ্গ’ পদবি ব্যবহার করতেন। সরকারি চাকরি ও লেখাপড়ার ক্ষেত্রে সংরক্ষণের বহুবিধ সুবিধা থাকায় বর্তমানে জনজাতীয় পরিচয় ব্যবহার করার প্রবণতা বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে। কিন্তু সাংস্কৃতিক দিক থেকে মূলের সঙ্গে যোগ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে পড়েছে।

দার্জিলিংবাসী নেপালিরা অনুপ্রবেশকারী এবং লেপচারা পাহাড়ের একমাত্র আদি অধিবাসী। ফলে বহিরাগত সম্প্রদায়কে দমাতে আদিবাসী গোষ্ঠীকে তোল্লাই দিলেই কেল্লা ফতে— এমন সরল ভাবনা থেকে অনেকে গোর্খাল্যান্ড দাবির যৌক্তিকতাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন। উপনিবেশ ও উত্তর উপনিবেশ কাল প্রায় দুশো বছর ধরে পাহাড়ের অধিবাসীগণ যে ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের পরম্পরাকে আত্মস্থ করে ভারতবর্ষের মূলধারার সংস্কৃতিকে রক্ত জুগিয়েছে এবং প্রাণশক্তি অর্জন করেছে, তাকে কি কোনও ভাবেই অস্বীকার করা যায়? ভারতের মতো একটি বহুত্বপ্রাপ্ত বিরাট দেশে ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি এবং সেইসঙ্গে নৃতাত্ত্বিক আত্মপরিচয়ের পরিসর থেকে দার্জিলিং পাহাড় যদি আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার তোলে, তা হলে সেই দাবিকে নস্যাৎ করাটাই হবে রাষ্ট্রীয় প্ররোচনার এক গূঢ় অন্তর্ঘাত।

আবার একটু অন্য ভাবেও সমস্যাটিকে ভাবা যেতে পারে। আজকে দুনিয়ায়, বিশেষত গ্লোবালাইজেশনের ক্রান্তিকালে আত্মনিয়ন্ত্রণের তত্ত্বটিকে একটি প্রাগৈতিহাসিক ভাবনা বলে মনে হতে পারে। শাসনের বিকেন্দ্রীকরণ করলেই কি মুশকিল আসান? বাম জমানার দার্জিলিং পার্বত্য উন্নয়ন পর্ষদ কিংবা তৃণমূল জমানার জিটিএ-এর ললিপপ দিয়ে পাহাড়ের ক্ষোভ সামাল দেওয়া যে যাবে না, সেটা রাষ্ট্রশক্তির বোঝা উচিত ছিল। বিমল গুরুঙ্গরা জিএনএলএফ-কে শেষ করে জিটিএ-র নৈবেদ্য খেতে চেয়েছিল। বাদ সেধেছে তারই দলের সাধারণ কর্মী ও পাহাড়ের জনতা। ফলে গুরুঙ্গদের পরিণতিও ঘিসিঙ্গদের মতো হবে কি না, তার কোনও গ্যারান্টি দেওয়া মুশকিল।

এখন কেন্দ্র ও রাজ্যের সদিচ্ছার উপরেই পাহাড়ের ভাগ্য ঝুলে রয়েছে।

শিবশংকর পাল

কৃষ্ণনগর, নদিয়া

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।

ই-মেল: letters@abp.in

যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়

ভ্রম সংশোধন

প্রতিবেদনে (২৯-৭, পৃ ১১) লেখা হয়েছে, আলিপুরদুয়ারের বাসিন্দা কন্যাশ্রী অনিন্দিতা সাহা কলকাতায় মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার নিয়েছে। অনিন্দিতা আলিপুরদুয়ার ইন্ডোর স্টেডিয়ামে পুরস্কৃত হয়েছে। অনিচ্ছাকৃত এই ত্রুটির জন্য আমরা দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন